কেস ১
আভা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। মা-বাবার খুব ইচ্ছা মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে স্কলারশিপ পাক। কিন্তু মা-বাবার অভিযোগ, মেয়ে খুবই অলস এবং একদম পড়াশোনায় মনোযোগী নয়। সে অঙ্ক একদম করতে চায় না। গত পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের মধ্যে মাত্র ৪০ পেয়েছে। এ নিয়ে মা-বাবা তাকে উঠতে-বসতে বকা দিচ্ছে। ‘আমার বন্ধুর মেয়ে এত ভালো করে, তোকে আমরা কী খাওয়াই না! কেন পারবি না অঙ্ক?’ আভা অঙ্ককে এতটাই ভয় পায় যে অঙ্ক কথাটা শুনলেও অশান্তি লাগে।
কেস ২
সৌভিক অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। স্কুলে দুষ্টুমির অভিযোগে তার মা-বাবার অশান্তির শেষ নেই। বাসায়ও পড়াশোনা খুব একটা করে না। নানা ধরনের কাজ নিয়ে সে ব্যস্ত। অন্য ক্ষেত্রে নানা বুদ্ধির স্বাক্ষর রাখলেও স্কুলের রেজাল্টে তার প্রতিফলন নেই। অথচ একটু পড়লেই তার সব পড়া হয়ে যায়। আভা ও সৌভিক দুজনেরই পড়াশোনায় অসুবিধা। কিন্তু আইকিউ পরীক্ষায় দেখা গেল দুজন দুই প্রান্তের। আভার আইকিউ ৮০ এবং সৌভিকের আইকিউ ১২৫। আভা কম আইকিউর কারণে পড়াশোনায় একটু ধীরগতির। তার ওপর স্বাভাবিক গতির চেয়ে বেশি গতির পড়াশোনার চাপ থাকায় সে তার যতটুকু ভালো করার কথা ছিল, তা-ও করতে পারছে না।
অন্যদিকে সৌভিকের স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বুদ্ধি হওয়ায় গড়পড়তার শিক্ষার্থীদের জন্য পরিচালিত ক্লাসে সে বোর হয়ে যায়। তার আরো জানার চাহিদা ক্লাসে মূল্যায়িত তো হয়ই না বরং সে ‘বেশি কথা বলার’ অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। তখন সে ক্লাসে দুষ্টুমি শুরু করে। ফলে শিক্ষকদের সঙ্গে আরো দূরত্ব বেড়ে যায়। শিক্ষকদেরও সে অপারদর্শী হিসেবে চিহ্নিত করে। পরিণতিতে পরীক্ষার ফল খারাপ। শুধু বুদ্ধিই ভালো ফলের জন্য যথেষ্ট না হলেও শিক্ষণ পদ্ধতি গ্রহণের ক্ষেত্রে বুদ্ধাঙ্কের বিষয়টি মাথায় রাখতে হয়। কম আইকিউ ও বেশি আইকিউ উভয় ধরনের শিক্ষার্থীর জন্য একটু আলাদা কেয়ার নিতে হয়। না হলে তারা ক্লাসে ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারে না। অন্যদিকে ঝুঁকে পড়ে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলে। তাই শিক্ষার্থীদের আইকিউর মাত্রা জেনে তাদের পড়ানোর ধরন নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
কম আইকিউ
স্বাভাবিক আইকিউ হলো ৯০ থেকে ১১০। আইকিউ ৮৫ থেকে ৭০ পর্যন্ত হলে শিশুরা জ্ঞানীয় কাজে একটু ধীরগতির হয়। কিন্তু তাই বলে তারা মানসিক প্রতিবন্ধী নয়। তাদেরও সম্ভাবনা রয়েছে ভালো কিছু করার। কিন্তু তাদের ওপর যদি টপ রেজাল্ট করার চাপ থাকে, তবে সে পড়াশোনা ভালো করার পরিবর্তে ভয় পেয়ে যায়। তাই প্রত্যাশাটি বাস্তবসম্মত হতে হবে। পরীক্ষায় কেমন ফল হলো, তা না দেখে তারা কতটা চেষ্টা করছে সেদিকে জোর দিতে হবে। এই শিশুদের এমনভাবে পড়াশোনা করাতে হবে যেন তাদের আত্মমর্যাদাবোধ অটুট ও আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে। কম গতির পড়াশোনার কারণে তাদের বকাঝকা করা যাবে না।
বুঝতে হবে, এটি তাদের অপরাধ নয়। তাদের ধীরে ধীরে ও প্রতিটি বিষয় সহজ-সরল ভাবে উপস্থাপন করতে হবে। সম্ভব হলে পড়ার বিষয়বস্তুগুলো ছবি ও ভিডিও আকারে দেখাতে হবে। প্রয়োজনে পড়াশোনা সহজ করার জন্য কিছু কৌশল শেখাতে হবে। যেমন কিভাবে ক্লাসে নোট নিতে হয়, কিভাবে সহজে মনে রাখা যায়, অঙ্ক করার সহজ নিয়ম, পরীক্ষার জন্য কিভাবে প্রস্তুতি নিলে সহজ হয়, পরীক্ষার হলে কিভাবে লিখতে হবে ইত্যাদি অত্যন্ত ধৈর্যসহকারে শেখাতে হবে।
বেশি আইকিউ
১২০-এর ওপরের আইকিউ-সম্পন্ন শিশুর জ্ঞানীয় সক্ষমতা তুলনামূলক বেশি থাকে। তাদের চিন্তাচেতনাও অন্যদের তুলনায় উন্নত হয়। ফলে ক্লাসে সবার জন্য যা বারবার বলা হয় তা তাদের জন্য একবারই যথেষ্ট। এ কারণে তারা বোর হয়ে যায়।
অনেক সময় এই শিশুরা ক্লাসে এমন কিছু প্রশ্ন করে, যা আরো বড় ক্লাসের জন্য। এমনকি মা-বাবা ও শিক্ষকদেরও ওই বিষয়টি জানা না-ও থাকতে পারে। তাদের বেশি সহজ করে বারবার বোঝালে অনেক সময় তারা বিরক্ত হয়। তাই তাদের প্রয়োজন বুঝে পড়াতে হবে। জ্ঞানীয় চাহিদা পূরণের জন্য তাদের পাঠ্যপুস্তকের বাইরে গঠনমূলক ও তথ্যবহুল বই পড়তে দিতে হবে। তাদের প্রশ্নকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে যথাযথ উত্তর দিতে হবে। উত্তর দিতে না পারা মানে শিক্ষক হিসেবে খারাপ তা নয়।
উত্তর দিতে না পারলে কিভাবে সে উত্তরটি জানতে পারে, তা তাকে জানাতে হবে অথবা সঠিক উত্তর জেনে উত্তরটি দিতে হবে। প্রয়োজনে তাকে দিয়ে বিষয়ভিত্তিক অথচ পাঠ্যক্রমের বাইরের পড়াশোনাও করাতে হবে। অন্য শিক্ষার্থীদের শেখানোর জন্য দায়িত্বও দেয়া যেতে পারে। তার মেধার যথাযথ স্বীকৃতি দিতে হবে। মা-বাবার উচিত শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলা, যাতে বেশি আইকিউর বিষয়টি শিক্ষকরা জানতে পারেন এবং করণীয় কী হবে তা বুঝতে পারেন।
তানজির আহম্মদ তুষার
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও সহকারী অধ্যাপক
মনোবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়