শিক্ষকদের বিভিন্ন সমস্যা দূরীকরণে এবার আসছে শিক্ষকনীতি। ‘শিক্ষকনীতি’ প্রণয়নে এরই মধ্যে শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, সরকার এবং এনজিওদের মধ্যেকার সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
শিক্ষকের ওপরই শিক্ষাব্যবস্থার মান নির্ভর করে। শিখনের মান বৃদ্ধিতে শিক্ষকদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ একান্ত প্রয়োজন। এক্ষেত্রে শিক্ষকরা যদি সঠিকভাবে সহায়তা পায় তাহলে শিক্ষায় মানের উন্নতি ঘটে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। আর যদি তারা সহায়তা না পায় তাহলে শিক্ষার মানের অবনতি ঘটে। এজন্য শিক্ষকদের পরিপূর্ণভাবে গড়ে তুলতে এই নীতি সহায়ক হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে শিক্ষকনীতি প্রণয়ন সংক্রান্ত ইউনেস্কোর প্রস্তাবনা অনুসারে বাংলাদেশে আয়োজিত প্রথম সভা শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে অংশ নেন শিক্ষা বিষয়ক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও, ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান এবং প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তরের শিক্ষক প্রতিনিধি।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, ‘শিক্ষকনীতি’ প্রণয়নে শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, সরকার এবং এনজিওদের সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০, শিক্ষকদের অধিকার ও করণীয় সংক্রান্ত ১৯৬৬ ও ১৯৯৭ সালের সুপারিশমালা, গ্লোবাল মনিটরিং রিপোর্ট ২০১৩/১৪ এবং ইনিশিয়েটিভ ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ও অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ এর শিক্ষক সংগঠনগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে প্রণীত ২৬ দফা সনদ বাংলাদেশে শিক্ষকনীতি তৈরিতে ভালো অবদান রাখবে বলে তারা মনে করেন। বক্তারা সভায় আলোচিত বিভিন্ন প্রস্তাব ও সুপারিশ শিক্ষক সংগঠন ও এনজিওগুলোর যৌথ সভায় চূড়ান্ত করে সরকারের সঙ্গে আলোচনারও পরামর্শ দেন।
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ এর মতে,
শিক্ষকরা শিক্ষকনীতি নিয়ে বেশি সোচ্চার হবে, কারণ তাদের কাছে এটা হবে নতুন আরেকটি রক্ষাকবচ। অভিভাবক ও শিক্ষা প্রশাসনও শিক্ষকদের দায়িত্ব পালনে শিক্ষকনীতির যথাযোগ্য সদ্ব্যবহার করতে পারবেন বলে তিনি মনে করেন।
শিক্ষক সংগঠন, শিক্ষা এনজিওগুলোর উচিত অবিলম্বে সরকারের সঙ্গে শিক্ষকনীতি কী; কীভাবে, কাদের নিয়ে তা প্রণয়ন করা দরকার- এসব নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেয়া দরকার বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি শিক্ষক আন্দোলনের কর্মসূচিতে শিক্ষকনীতির দাবি নতুন উপাদান যোগ করবে এবং আন্দোলনে নতুন ধারা সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি করবে।
উল্লেখ্য, ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর প্যারিসে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারগুলোর সম্মেলনে ১৪৪টি সুপারিশসহ শিক্ষকদের মর্যাদা সনদ গৃহীত হয়। পরে জাতিসংঘের আরেক সংগঠন আইএলও তা অনুমোদন করে। এ ধারাবাহিকতায় ২৮ বছর ধরে আলোচনা-পর্যালোচনান্তে ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ অধিবেশনে তৎকালীন মাহপরিচালক ফেডেরিকো মেয়রের প্রস্তাবক্রমে ৫ অক্টোবরের সুপারিশগুলো স্মরণীয় করে রাখতে ওই দিনটিকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়।
তবে ১৯৬৬ সালের সুপারিশমালা ছিল মূলত নার্সারি কিন্ডারগার্টেন, প্রাথমিক, কারিগরি, বৃত্তিমূলক, চারুকলাসহ স্কুলে পাঠদানকারী শিক্ষকদের জন্য। মাধ্যমিক (উচ্চ)-পরবর্তী স্তরগুলোর সুস্পষ্ট উল্লেখ সেখানে ছিল না। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালের ১৫ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর প্যারিসে ইউনেস্কোর এক বিশেষ অধিবেশনে উচ্চতর স্তরে শিক্ষাদানকারী শিক্ষকদের মর্যাদা সংক্রান্ত সুপারিশ প্রণীত হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ১৯৬৬ ও ১৯৯৭ সালের উভয় সুপারিশমালা যুগ্মভাবে শিক্ষকদের মর্যাদা সনদ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং বিশ্বব্যাপী সর্বস্তরের শিক্ষক ওই সনদের স্মারক দিবস হিসেবে ৫ অক্টোবর প্রতি বছর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করবেন।
জাতীয় শিক্ষানীতি, গ্লোবাল মনিটরিং রিপোর্টে শিক্ষক প্রসঙ্গ: জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষকদের প্রসঙ্গে যা বলা হয়েছে তার কয়েকটি-
১. ‘সুশিক্ষা ও মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানসম্পন্ন শিক্ষক। শিক্ষকের গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য একদিকে প্রয়োজন বিজ্ঞানসম্মত ও স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করা, অন্যদিকে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষক-শিক্ষা এবং চাহিদাভিত্তিক যুগোপযোগী পৌনঃপুনিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের পেশাগত উৎকর্ষ সাধন করা (পৃষ্ঠা ৫৬)। শিক্ষক সংগঠনগুলোকে তাদের কর্মকাণ্ড শুধু পেশাগত দাবি আদায়ের মধ্যে নিয়োজিত না রেখে শিক্ষকদের মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য তাদের উৎসাহিত করা হবে’ (পৃষ্ঠা ৫৭);
২. ‘আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সব স্তরের শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হবে’ (পৃষ্ঠা ৫৮);
৩. ‘শিক্ষকদের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা: শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা শুধুমাত্র সুবিন্যস্ত বাক্যগাঁথার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে প্রকৃত অর্থে তাদের সামাজিক মর্যাদা দেয়া না হলে শিক্ষার মানোন্নয়ন করা সম্ভব নয়’ (পৃষ্ঠা ৫৮);
৪. ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ছুটির সময় ছাড়া শিক্ষাসংক্রান্ত কাজের বাইরে অন্যান্য কাজে সম্পৃক্ত করা হবে না’ (পৃষ্ঠা ৫৯)।
শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার্থীদের জন্য সুখবর
২০১৫ সালের মধ্যে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে ১.৬ মিলিয়ন নতুন শিক্ষক নিয়োগের জন্য ‘শিক্ষকদের সম্ভাবনা উন্মুক্তকরণই শিখন সংকটের সমাধান’- এ কথা উল্লেখ করে সবার জন্য শিক্ষা, গ্লোবাল মনিটরিং রিপোর্ট ২০১৩/৪-এ যে দশটি প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছে তা হল:
১. শিক্ষক ঘাটতি পূরণ করা,
২. শিক্ষাদান করতে সর্বোত্তর প্রার্থীদের আকর্ষণ করা,
৩. সব শিশুর চাহিদা পূরণে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা,
৪. শিক্ষকদের সহায়তা করার জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও মেনটর প্রস্তুত করা,
৫. চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষকের ব্যবস্থা করা,
৬. উত্তম শিক্ষকদের ধরে রাখার জন্য প্রতিযোগিতামূলক পেশা এবং বেতন কাঠামোর ব্যবস্থা করা,
৭. সর্বোচ্চ ফলাফল পেতে শিক্ষকদের সুশাসনের উন্নয়ন,
৮. শিখন উন্নয়নে শিক্ষকদের উদ্ভাবনী শিক্ষাক্রমের সঙ্গে পরিচিত করা,
৯. না শেখার ঝুঁকির মধ্যে থাকা শিক্ষার্থীদের শনাক্ত ও সহায়তার জন্য শিক্ষকদের শ্রেণীকক্ষে মূল্যায়ন উন্নয়ন করতে হবে,
১০. প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের উত্তম তথ্য প্রদান