জানুয়ারির বেতনের সঙ্গেও নতুন স্কেলে বেতন পাচ্ছেন না ৫ লাখ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী। অর্থ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দৈনিক শিক্ষাকে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। জানতে চাইলে শনিবার সন্ধ্যায় একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বর্ধিত বেতনের জন্য টাকা চেয়ে গত সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
একজন অতিরিক্ত সচিব শনিবার সন্ধ্যায় দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, ‘এমপিও শিক্ষকদের জানুয়ারির বেতনের চেক ছাড় করার সময় ঘনিয়ে এসেছে। কিন্ত এই অল্প সময়ের মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী টাকা বরাদ্দ দেওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।’
শিক্ষাসচিব মো. সোহরাব হোসাইন অবশ্য আশা প্রকাশ করেছেন, আগামী সপ্তাহ নাগাদ অতিরিক্ত বরাদ্দের ছাড়পত্র তারা পেতে পারেন। পেলেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় দ্রুততার সঙ্গে বেতন দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
এদিকে বকেয়া বেতন পেতে শিক্ষকদের বিলম্বের জন্য শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অদক্ষতাকে দায়ী করেছেন শিক্ষক নেতারা। শিক্ষক সমিতি ঐক্যজোটের মহাসচিব নজরুল ইসলাম রনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আগেই এসব প্রস্তাবনার ফাইল তৈরি করে রাখার কথা। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষকদের স্বার্থ দেখার মত কোন লোক মন্ত্রণালয়ে না থাকায় এখন নতুন স্কেলে বেতন পেতে পাঁচ লাখ শিক্ষককে বিলম্ব বিড়ম্ভনা সহ্য করতে হবে। অতীতের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী জানুয়ারির বেতন হাতে পেতেই ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে শিক্ষকদের।
ফে্ব্রুয়ারির বেতন পেতে অপেক্ষা করতে হবে মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ। কিন্তু মার্চেও বকেয়া বেতন হাতে পা্ওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কঠোর আন্দোলনের বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির নেতা আবু জামিল সেলিম বলেন, ২০ ডিসেম্বরের পরিপত্র বাদ দিতে হবে। সরকারি শিক্ষকরা একই বই পড়ান। নতুন স্কেলের বর্ধিত বেতন তারা হাতে পেয়েছেন কিন্তু আমরা ৯৭ ভাগ বেসরকারি শিক্ষক তীর্থের কাকের মতো পথ চেয়ে আছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একজন গিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে বেসরকারি শিক্ষকদের বরাদ্দ চাইবেন, তদবির করবেন, এমন কেউ নেই। দনিয়া এ কে হাইস্কুল এন কলেজের ইংরেজির এই শিক্ষক বলেন, মন্ত্রণালয়ে কিংবা শিক্ষা অধিদপ্তরে বেসরকারি শিক্ষকদের কোনও প্রতিনিধি নেই। লাগাতার কর্মবিরতি ছাড়া নতুন বেতন পাওয়া যাবে না বলে মনে করেন তিনি।
গত ১ জুলাই থেকেই নতুন স্কেলে পাবেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের এমন প্রজ্ঞাপনে শিক্ষরা খুশী হলেও বর্ধিত বকেয়া বেতন কবে নাগাদ হাতে আসবে তা নির্ভর করছে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে টাকা বরাদ্দ পা্ওয়ার ওপর।
নতুন পে-স্কেলে গত বছরের ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) বকেয়া বেতন বাবদ ২ হাজার ৪৬৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এর মধ্যে বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার বেতনভাতা বাবদ ২ হাজার ৩৮৩ কোটি ২২ লাখ ৮২ হাজার ৯০০ টাকা এবং কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য ৮৫ কোটি ৯৪ লাখ ৪৪ হাজার ১৯৪ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। গেল মঙ্গলবার এ প্রস্তাবটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
উল্লেখ্য, গত ১৫ ডিসেম্বর সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কিন্তু ওই প্রজ্ঞাপনের বাইরে রাখা হয় এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেতনের বিষয়টি। পরবর্তী সময়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অষ্টম বেতন স্কেল পাওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণ করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির সুপারিশের আলোকে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উল্লিখিত প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে বলা হয়, গত ডিসেম্বরে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা সপ্তম স্কেলে বেতন উত্তোলন করেছে। অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষণার পর কর্মরত শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর- এ ছয় মাসে বকেয়া বেতন বাবদ এক হাজার ৯৮০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে।
এর মধ্যে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর- এ তিন মাসে এমপিওভুক্ত কলেজের জন্য বেতন খাতে প্রায় ২৩৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর-এ তিন মাসে প্রয়োজন হবে ২৩৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
এছাড়া জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর- এ তিন মাসে এমপিওভুক্ত স্কুলের বেতন খাতে ৪৭৯ কোটি টাকা এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর- এ তিন মাসে প্রয়োজন হবে প্রায় ৪৮১ কোটি টাকা। আর মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন বাবদ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর- এ তিন মাসে প্রয়োজন হবে প্রায় ২৭৫ কোটি টাকা এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে একই খাতে টাকা ব্যয় হবে প্রায় ২৭৬ কোটি টাকা।
আগামী জুলাই থেকে বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার সংশ্লিষ্টদের বাড়ি ভাড়া ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা এবং চিকিৎসা ব্যয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ দুই ভাতার কারণে বর্তমানের তুলনায় অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হবে ৪০২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে আরও বলা হয়, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল বাস্তবায়নে প্রায় ২৫১ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। সপ্তম বেতন কাঠামোর তুলনায় ছয় মাসের বকেয়া বেতনের (গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর) জন্য অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হবে ৭১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত বেসরকারি কলেজের বকেয়া তিন মাসের বেতন খাতে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) অর্থের প্রয়োজন হবে ১৮ কোটি ২২ লাখ টাকা।
আর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে অর্থের প্রয়োজন হবে প্রায় ১৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা। একইভাবে স্কুলের ক্ষেত্রে গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসের বকেয়া বেতন খাতে অর্থের প্রয়োজন হবে ১৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর- এ তিন মাসে প্রয়োজন হবে ১৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা। পাশাপাশি মাদ্রাসার জন্য গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর ছয় মাসের বকেয়া বেতন খাতে অর্থের প্রয়োজন হবে এক কোটি সাত লাখ টাকা।
কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাড়ি ভাড়া আগামী জুলাই থেকে ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা এবং চিকিৎসা ব্যয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ দুই ভাতার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বর্তমানের তুলনায় অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হবে ১৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
সূত্র: দৈনিক শিক্ষা