মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ২০১২ সালের ৯ মার্চ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে এক হাজার ৯৬৫ জনকে নিয়োগ দেয়া হবে বলে বিজ্ঞপ্তি দেয়। ২০১৩ সালের জুন মাসে এ বিষয়ে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ওই বছরেরই ২৮ জুন উত্তীর্ণ প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করার কথা ছিল। কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে বড় অংকের বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠায় শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে তা স্থগিত রাখা হয়।
কিন্তু ওই লিখিত পরীক্ষার সূত্র ধরে বিভিন্ন পরীক্ষার্থীর সাথে যোগাযোগ করা হয়। নিয়োগ পাইয়ে দেয়া হবে এমন প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন পদের জন্য বিভিন্ন অংকের টাকা দাবি করা হয়। কারো কাছ থেকে পুরো টাকা, বা কারো কাছ থেকে অর্ধেক টাকা নেয়া হয়। এক সময় ওই প্রার্থীকে নিয়োগপত্রও দেয়া হয়। কিন্তু নিয়োগপত্র অনুযায়ী যোগদান করতে গিয়ে সংশ্লিষ্টরা জানতে পারে এটি ছিল প্রতারণার জাল।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তার পরিচয় দিয়ে প্রার্থীদের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই প্রতারক চক্র। এ নিয়ে রাজধানীর শেরে বাংলানগর থানায় অভিযোগও করেছেন কয়েকজন ভুক্তভোগী।
থানায় দায়ের করা অভিযোগে বলা হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিচয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কামরুজ্জামান কামরুল গত ২০ মার্চ ২০১৫ এবং একই বছরের ২০ জুলাই চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন প্রার্থীদের কাছ থেকে ৭০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যান। অভিযোগে বলা হয়, কামরুল একাধিক মোবাইল নম্বর ব্যবহার করতেন। বর্তমানে ওই নম্বরগুলো বন্ধ রয়েছে। এছাড়া ওই কামরুল নিজেকে এখন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের লোক বলে পরিচয় দিচ্ছে।
এই নিয়োগের বিষয় মাউশির উপ-পরিচালক ও নিয়োগ কমিটির প্রাক্তন সদস্য কামাল হায়দার বলেন, এটি একটি প্রতারণা। প্রতারক চক্র নিয়োগ প্রার্থীর নামে যে ক্রমিক নম্বর ব্যবহার করছে, তা মাউশির নয়। এছাড়া নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় মাউশি কাউকে নিয়োগপত্রও পাঠায়নি। এছাড়া মাউশি এ ধরনের ক্রমিক নম্বর ব্যবহার করেন না।
প্রতারক চক্রের কাছ থেকে ভুয়া নিয়োগপত্র পাওয়া এক প্রার্থী বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকলেও কামরুল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা হিসাবে আমাদের সাথে মোবাইলে যোগযোগ করেছে। শিক্ষা অধিদপ্তরের বিভিন্ন কর্মকর্তার দপ্তর ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কামরুলের অবাধ যাতায়ত ছিল। এ কারণে আমাদের বিশ্বাস হয়েছে, সে ওই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। শিক্ষা ভবনের ভেতরেই আমাদের সাথে তার কথা হয়। প্রতারকচক্র মাউশির বিভিন্ন স্মারক নং ও সিল ব্যবহার করেছে। ব্যবহার করেছে ক্রমিক নাম্বারও।
মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কামরুল নামে এক কর্মকর্তা থাকলেও ঠিকানা ও ছবির সাথে তার মিল নেই।
প্রতারক চক্রের কিছু কাগজপত্র ইত্তেফাকের কাছে আসে। কাগজপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ওই চক্র বিভিন্ন পদে ন্যূনপক্ষে একহাজার নিয়োগের প্রক্রিয়া দেখিয়ে টাকা আত্মসাতের চেষ্টা করছিল। ইতিমধ্যে প্রায় কোটি টাকার বেশি আত্মসাত্ করেছে বলে বিভিন্ন প্রার্থীরা অভিযোগ করেছে। এছাড়া অন্য প্রার্থীদের কাছ থেকেও টাকা নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল।
রংপুরে স্থায়ী বাসিন্দা বেলাল হোসেন। পিতা আক্তার হোসেন, মাতা : মর্জিনা বেগম, জেলা রংপুর, থানা রংপুর সদর। এমএলএসএস পদে তাকে নিয়োগ দিয়েছিল প্রতারক চক্র। তাকে কথিত নিয়োগ দেয়া হয়েছিল রংপুর সরকারি কলেজের এমএলএসএস পদে। বেলাল জানান, প্রতিবেশী এক ব্যক্তির মাধ্যমে জানতে পারি শিক্ষা অধিদপ্তরে নিয়োগ দেয়া হবে। পরীক্ষা দিতে হবে না, শুধু উপস্থিতির স্বাক্ষর দিলেই হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়ার আগে অর্ধেক টাকা, বাকি টাকা নিয়োগের পরে দিলেই চলবে। কিন্তু স্বাক্ষর দেয়ার পর যখনই সব টাকা দাবি করে তখনই আমি পিছু হটি। ইতিমধ্যে আমার নিয়োগ হয়েছে বলে আমাকে জানানো হয়েছে। আমার কাছে বিভিন্ন সময় টাকা দাবি করছে। এ কারণে আমি যোগদান করতে রাজি হইনি।
ফরমান নামে এক ব্যক্তি জানান, নিকটস্থ কয়েক প্রার্থীর কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা তিনি তুলে দেন। কিন্তু পরে জানতে পারেন এটি প্রতারণার জাল।
সূত্র জানিয়েছে, মাউশির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী মোট এক হাজার ৯৬৫ জন তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের সিদ্ধান্ত ছিল। এগুলো হচ্ছে- প্রদর্শক (পদার্থ) ৯২ জন, প্রদর্শক (রসায়ন) ৯৫ জন, প্রদর্শক (প্রাণিবিদ্যা) ৬৬ জন, প্রদর্শক (উদ্ভিদবিদ্যা) ৪৬ জন, প্রদর্শক (ভূগোল) ১০ জন, প্রদর্শক (মৃত্তিকাবিজ্ঞান) ২ জন, প্রদর্শক (সঙ্গীত) ১ জন, প্রদর্শক (গার্হস্থ্য) ৩ জন, শরীরচর্চার শিক্ষক ৭৬ জন, গবেষণা সহকারী ৯ জন, সহকারী গ্রন্থাগারিক কাম-ক্যাটালগার ৬৪ জন, সাঁটলিপিকার-কাম কম্পিউটার অপারেটর ২ জন, সাঁঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম-কম্পিউটার অপারেটর ৪ জন, উচ্চমান সহকারী ৭১ জন, অফিস সহকারী-কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক ১৮৯ জন, স্টোর কিপার/ক্যাশিয়ার ১৩ জন, হিসাব সহকারী ৪৩ জন, ক্যাশিয়ার ৩৯ জন, স্টোর কিপার ৩৩ জন, মেকানিক-কাম ইলেকট্রিশিয়ান ৩১ জন, বুক স্টার ২৯ জন, এমএলএসএস ৯৫৮ জন, সুইপার ৮৯ জন। এসব পদের বিপরীতে আবেদন করেছিল প্রায় এক লাখ ৭৬ হাজার প্রার্থী। এ লক্ষ্যে উচ্চমান সহকারী পদে ২০১৩ সালের ১৪ জুন ৩৯টি কেন্দ্রে লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয়। অন্যান্য পদেও ওই বছরের ২১ জুন দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ২৮ জুন লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশের কথা ছিল, যা নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্থগিত করেন শিক্ষামন্ত্রী।