‘প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা ঘিরে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বাসা বেঁধেছে। এ পরীক্ষাকে ঘিরে প্রাইভেট পড়ানো ও কোচিং বাণিজ্যের মহোৎসব চলছে সারাদেশে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় অর্ধেক শিক্ষকই এ-সংক্রান্ত কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। এ ছাড়া এ নিয়ে আরও ১৩ ধরনের অনিয়ম ঘটছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘গণসাক্ষরতা অভিযান’ পরিচালিত বার্ষিক এডুকেশন ওয়াচের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে নানা অনিয়ম বেড়ে গেছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে। বাস্তবতা বিবেচনা করে সমাপনী পরীক্ষা তুলে দেওয়া যায় কি-না, তাও বিবেচনা করার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
গতকাল বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এলজিইডি মিলনায়তনে বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযান ২০১৪ সালের এডুকেশন ওয়াচ রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে পৃথক গবেষণা তথ্য উপস্থাপন করা হয়। দেশের ১৫০টি উপজেলা, থানা, পৌরসভার ৫৭৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর গবেষণা পরিচালনা করে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি। ‘প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা কোন পথে?’ শিরোনামে প্রকাশিত এই নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আনীত অভিযোগের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, এ পরীক্ষা বন্ধ করা হবে কি-না, তা নিয়ে আরও আলাপ-আলোচনা করার প্রয়োজন আছে। সমাপনী পরীক্ষা বন্ধ করতে হলে আগে প্রাথমিক শিক্ষার স্তর অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা চাই গুণগত শিক্ষা। শিক্ষার মান ঠিক না থাকার জন্য শিক্ষকরাই দায়ী। শিক্ষকদের ক্লাসে আরও মনোনিবেশ করার আহ্বান জানান মন্ত্রী।
এডুকেশন ওয়াচের রিপোর্টে বলা হয়, মোটাদাগে কয়েক ডজন অনিয়ম হচ্ছে সমাপনী পরীক্ষা ঘিরে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো_ প্রাইভেট-কোচিংয়ের রমরমা বাণিজ্য, পরীক্ষা হলে আসনবিন্যাসে অনিয়ম, পারস্পরিক সাহায্যের দ্বার উন্মুক্ত করা, হল পরিদর্শকরা মুঠোফোনে বাইরে থেকে উত্তর সরবরাহ করা, প্রশ্নের উত্তর মুখে ও ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে দেওয়া, একজনের উত্তর অন্যজনকে দেখার সুযোগ করে দেওয়া, শেষ ৪০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা পরীক্ষা হলে অরাজক পরিস্থিতি, শেষ সময় পরিদর্শকের সহায়তায় একজনের সঙ্গে অন্যজনের উত্তর মেলানো, পরীক্ষকদের উদারভাবে খাতা মূল্যায়ন, অর্থের বিনিময়ে উত্তরপত্রের গোপন কোড নম্বর ফাঁস করে দেওয়া, শিক্ষক নন এমন লোক দিয়ে পরীক্ষা হল পরিদর্শন, গাইড ও সাজেসন্সের নামে একশ্রেণীর শিক্ষকের প্রশ্ন ফাঁস ও বিতরণ, পাসের হার বাড়ানোর নামে নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি। এ জন্য শ্রেণীকক্ষে পাঠ ও শিক্ষাদান জোরদার করা, সমাপনী পরীক্ষার উচ্চ প্রতিযোগিতামূলক চরিত্রের পরিবর্তন, সমাপনী পরীক্ষা জাতীয়ভাবে না করে স্থানীয়ভাবে আয়োজন, প্রশ্নপত্র প্রান্তিক যোগ্যতাভিত্তিক করা। এসব সুপারিশ করেছে গণসাক্ষরতা অভিযান।
গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার এ প্রতিবেদনের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করে বলেন, তারা যেসব অভিযোগ করেছে, তার সঙ্গে আমি একমত। তবে এসব প্রতিবন্ধকতা রাতারাতি দূর করা সম্ভব নয়। আমি দায়িত্বে থাকতে এ সমস্যা যতদূর সম্ভব, সুরাহা করে যাব।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, সনদ দেওয়ার নামে প্রাথমিক সমাপনী নিয়ে বৈষম্য দূর করতে গিয়ে আরও বৈষম্য তৈরি করছি কি-না, তা দেখতে হবে। শিক্ষা খাতে নানা অনিয়ম ও বৈষম্য দূর করতে সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মত প্রকাশ করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা।
অনুষ্ঠানের সভাপতি পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, সমাপনী পরীক্ষার নামে কোমলমতি ছোট ছোট শিক্ষার্থীকে দুর্নীতি শেখানো হচ্ছে। তাদের কাঁধে বইয়ের বোঝা ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষানীতিতে শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার বিষয়টি না থাকলেও এ পরীক্ষা কেন নেওয়া হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
রমরমা কোচিং বাণিজ্য :প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক সমাপনীকে ঘিরে চলছে রমরমা কোচিং বাণিজ্য। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা এখন পুরোপুরি কোচিংনির্ভর হয়ে পড়েছে। পরীক্ষার্থীদের তৈরি করার জন্য মূল বই বাদ দিয়ে দলবদ্ধ কোচিং ও মডেল টেস্ট বিদ্যালয়গুলোর প্রধান কর্মকাণ্ডে পরিণত করেছে। এর সঙ্গে উপজেলা শিক্ষা অফিস যুক্ত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৮৬ শতাংশের বেশি বিদ্যালয় সাধারণ ক্লাস কার্যক্রম বাদ দিয়ে কোচিং করাচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এদের মধ্যে ৭৩ শতাংশ বিদ্যালয়ে কোচিং বাধ্যতামূলক। বাধ্যতামূলক কোচিংয়ের হার শহরের চেয়ে গ্রামের বিদ্যালয়ে বেশি।