ঠাকুরগাঁও প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের (পিটিআই) পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী আফিক হাসান। কিছুদিন বাদেই ওর বার্ষিক পরীক্ষা। পরীক্ষায় ভালো করতে এ সময় তার নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু গত সোমবার বেলা ১১টার দিকে তাকে দেখা গেল স্থানীয় এক কোচিং সেন্টারে ক্লাস করতে।
আফিকের মতো দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া অনেক শিশুই এখন নিজ বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত। তারা ব্যস্ত সময় পার করছে কোনো না কোনো ভর্তি কোচিংয়ে। ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক ও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় দুটির প্রতিটিতে বছরে একবার শুধু তৃতীয় শ্রেণিতে মাত্র ২৪০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পায়। কিন্তু ৪৮০টি আসনের বিপরীতে প্রতিবছর কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। আসন অনেক কম হওয়ায় শিশুদের সরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে মরিয়া অভিভাবকেরা সন্তানদের এ সময়ে বিদ্যালয়ের বদলে ব্যস্ত রাখেন ভর্তি কোচিংয়ে। ফলে শহরের কিন্ডারগার্টেন ও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এ সময় দ্বিতীয় শ্রেণির কক্ষগুলো ফাঁকা থাকলেও কানায় কানায় পূর্ণ থাকে ভর্তি কোচিং সেন্টারগুলো।
বিভিন্ন অভিভাবক ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঠাকুরগাঁও শহরে ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫টির মতো ভর্তি কোচিং সেন্টার চলে। এসব কোচিং সেন্টারে কমপক্ষে আড়াই হাজার শিক্ষার্থী কোচিং করে। ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসন পরিচালিত বিয়াল ল্যাবরেটরি স্কুলে ২০১৪ সালে প্রথম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২৮ জন। এ বছরের শুরুতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে মাত্র তিনজন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। গত জুনে সেই তিন শিক্ষার্থীও সরকারি বালক ও বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য বিদ্যালয় আসা বন্ধ করে দেয়। এখন দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছাড়াই চলছে স্কুলটি।
এ স্কুলের অধ্যক্ষ আবদুল হক দাবি করেন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠলেই অভিভাবকেরা সন্তান নিয়ে কোচিং সেন্টারগুলোতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। এর প্রভাবেই স্কুলটির দ্বিতীয় শ্রেণি শিক্ষার্থী শূন্য।
এ বছরে ঠাকুরগাঁও পিটিআইয়ের পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৭৬ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। কিন্তু গত সোমবার সকালে বিদ্যালয়ে গিয়ে মাত্র আট শিক্ষার্থীকে শ্রেণিকক্ষে পাওয়া যায়। এ সময় বাকিরা সবাই কোনো না কোনো ভর্তি কোচিংয়ে পড়ছে বলে জানান শ্রেণি শিক্ষক নাছিমা আকতার। এ ছাড়া গত সোমবার শহরের ইকো পাঠশালা ও কলেজের দ্বিতীয় শ্রেণির ৪১ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৫, দোয়েল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫১ জনের মধ্যে ৩১, সালেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১১০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪৩ জন বিদ্যালয়ে উপস্থিত ছিল।
গ্রোসারী বণিক সমিতি পরিচালিত রয়েল কিন্ডারগার্টেনে প্লে থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। এখানে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১১৮ জন শিক্ষার্থী পড়ছে। কর্তৃপক্ষ এসব শিক্ষার্থীকে সরকারি বালক ও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তির কোচিং করাচ্ছে।
রয়েল কিন্ডারগার্টেন পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নূরুল হুদা বলেন, তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তির কথা বিবেচনা করে তাঁরা দ্বিতীয় শ্রেণির কোচিংয়ে পাঠ পরিচালনা করেন। এ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ থাকার পরও নিজেদের শিক্ষার্থীদের কেন অন্য বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিং করানো হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিভাবকদের অনুরোধেই এমনটি করতে হচ্ছে।
গত সোমবার কথা হয় শহরের গোবিন্দনগর এলাকার সাকসেস কোচিং সেন্টারে পড়তে আসা ভর্তিপ্রত্যাশী কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। এর মধ্যে মারুফা জান্নাত নামের এক শিক্ষার্থী বলে, সে একটা স্কুলে ভর্তি হলেও ক্লাস করে না। মালিহা নামে আরেক শিক্ষার্থী বলে, সে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় তার খালার এক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আছে। তবে বিদ্যালয়টির নাম সে বলতে পারেনি।
আবু বক্কর সিদ্দিক নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘দ্বিতীয় শ্রেণির একজন ছাত্র যেভাবে ভর্তি কোচিং করছে, সেখানে নিজের ছেলেকে শুধু বাড়িতে পড়িয়েই নিশ্চিত থাকা যায় না। তাই ওকে গ্রামের একটি স্কুলে নামমাত্র ভর্তি করে দিয়ে শহরে কোচিং করাচ্ছি।’
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবু হারেস বলেন, বিদ্যালয় চলাকালে ভর্তি কোচিংয়ের কারণে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী উপস্থিতি কমে যাওয়ার তথ্য তাঁর জানা নেই। তবু এ বিষয়ে তিনি জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলবেন।
জেলা প্রশাসক মূকেশ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘বিদ্যালয় চলাকালে ভর্তি কোচিং পরিচালনার বিষয়টি নজরে এসেছে। এতে দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে উপস্থিত না হয়ে কোচিংয়ে ব্যস্ত থাকছে। কোচিং সেন্টার পরিচালকদের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করা হবে।
সূত্র: প্রথমআলো