বছরের পর বছর শহরের নামীদামী কলেজ ও অফিসে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের চাকরি করার সুযোগ বন্ধ করতে প্রধানমন্ত্রী অনুশাসন দিয়েছেন। বছরের পর বছর গ্রামের কলেজ ফাঁকা রেখে রাজধানী ঢাকাসহ অন্য বিভাগীয় শহরের কলেজগুলোতে শিক্ষা ক্যাডার ভু্ক্ত সরকারি কলেজ শিক্ষকদের সংযুক্তির নির্দেশ দিয়ে আসছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সাংবাদিকদের লেখায় এসব অপশাসন, স্বজনপ্রীতি ও ব্যর্থ প্রশাসনের খবর উঠে এসেছে বারবার।
দৈনিকশিক্ষার অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষকদের সংযুক্তি/প্রেষণ দেওয়ার বিনিময়ে শিক্ষা ও প্রশাসন ক্যাডারের কিছু প্রভাবশালী কর্তারা কখনো নগদ টাকা, উপঢৌকন, নারী শিক্ষকদের নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ, ঘুষের টাকার ভাগাভাগি ইত্যাদি নানাবিধ সুযোগ পেয়ে থাকেন। সরকারি কলেজ শিক্ষকরা অফিসে চাকরি করলে নিজেদের অফিসার ভাবতে ও পরিচয় দেওয়ার সুবিধা পেয়ে থাকেন যেটা গ্রামের কলেজে পদায়ন হলে শুধুই শিক্ষক পরিচয় দিতে হয়। অফিসে চাকরি করে নিজ নিজ সহকর্মীদের ‘একহাত’ দেখে নেওয়ার প্রবণতাও রয়েছে শিক্ষা ক্যাডারের একটা বড় অংশের মধ্যে। এই অংশটি যেকোনও কিছুর বিনিময়ে অফিস বা ঢাকার কলেজে চাকরি করতে চান। শিক্ষা অধিদপ্তরের কলেজ শাখায়, সেকায়েপ, সেসিপ, ঢাকা বোর্ডে এমন নারী শিক্ষকও রয়েছে কয়েকজন।
এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রেষণ/সংযুক্তি বাতিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ সংক্রান্ত চিঠি গত বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের পরিচালক আবুল কালাম শামসুদ্দিন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ‘মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার আওতাধীন বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের সদস্যদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরসহ অন্যান্য দপ্তর ও সংস্থায়, বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজে প্রেষণ/সংযুক্তি থাকা আদেশ বাতিল পূর্বক নিজ নিজ কর্মস্থলে ফেরত পাঠানোর জন্য নির্দেশ ক্রমে অনুরোধ করা হলো। সরকারি কলেজে সুষ্ঠু পাঠদানের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে অনুশাসন প্রদান করেছেন।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ নির্দেশনার মাধ্যমে কলেজ পর্যায়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় চলমান সংকটের অবসান সম্ভব হবে। তবে শূন্য পদেও শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।
তথ্য অনুযায়ী, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া সরকারি কলেজে ৩৬ জন শিক্ষকের স্থলে আছেন মাত্র ১৮ জন। ইতিহাস ও রসায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একজন শিক্ষকও নেই। তিন মাসে আগে রসায়নের শিক্ষককে কুষ্টিয়ার একটি কলেজে সংযুক্ত দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শিক্ষক না থাকায় পাঠদান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা এখন আর এই কলেজে ভর্তি হতে আগ্রহী নয়। কলেজের অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা বলছেন, এভাবে আর চলছে না।
ফেনীর সোনাগাজী সরকারি কলেজে বর্তমানে ইতিহাসের নিয়মিত কোনো শিক্ষক নেই। অথচ সেই কলেজ থেকে ৯ মার্চ ঢাকার সরকারি বাংলা কলেজে নমিতা বিশ্বাস নামে একজন সহকারী অধ্যাপককে সংযুক্ত করে আনা হয়েছে। ফেনী কলেজে ৪৩ জন শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র ২২ জন। একাউন্টিংয়ে একজন শিক্ষকও নেই। ইংরেজিতে আছেন মাত্র ১ জন। শিক্ষকরা জানিয়েছেন, এই কলেজে শিক্ষা কার্যক্রম ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
দেশের মফস্বল এলাকার বেশিরভাগ সরকারি কলেজের চিত্রই এমন। উপজেলা পর্যায়ে কোনো কোনো কলেজে মাত্র একজন শিক্ষক দিয়ে পুরো বিভাগ চলছে। একমাত্র শিক্ষক পালা করে উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক, অনার্স ও মাস্টার্স ক্লাসের শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিচ্ছেন।
আর ঢাকার কলেজের চিত্র ভিন্ন। পদের চেয়ে শিক্ষকের সংখ্যা বেশি। তিতুমীর কলেজের অধ্যক্ষ আবু নাসের জানিয়েছেন, এই কলেজে শিক্ষকের পদ আছে ৮৫টি। শিক্ষক আছেন ১০৯ জন। এমনিভাবে সরকারি বাঙলা কলেজ, ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সোহরাওয়ার্দীসহ ঢাকার ১৫ সরকারি কলেজের একই চিত্র।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, বছরের পর বছর রাজধানীর ১৫টি সরকারি কলেজে সংযুক্তি নিয়ে শিক্ষকতা করছেন এমন শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় চারশ। এছাড়া কেউবা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি), জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি), শিক্ষা বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসাবে সংযুক্ত রয়েছেন।
ঢাকা কলেজের এক শিক্ষক বলেন, সংযুক্তি ও প্রেষণ দেখিয়ে গ্রামের সরকারি কলেজ শূন্য করে মহানগরীর কলেজগুলোতে এসে ভিড় করেছে। ফলে ঢাকাসহ মহানগরীর কলেজগুলোতে প্রয়োজনের চেয়ে শিক্ষক সংখ্যা বেশি। আবার মফস্বলের সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষক সংকট থাকায় নিয়মিত ক্লাসও হচ্ছে না।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন সাংবাদিকদের বলেন, সংযুক্তির বিষয়ের কাজ করে থাকে মন্ত্রণালয়। বর্তমানে যেভাবে সংযুক্তি দেয়া হচ্ছে তার সমালোচনা করেন এই মহাপরিচালক।
দৈনিকশিক্ষার অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষা অধিদপ্তরে কাকে কোন পদে ও প্রকল্পে পদায়ন, সংযুক্তি দেওয়া হবে তা অনেকটা নির্ভর করে অধিদপ্তর থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো লিখিত ও মৌখিক প্রস্তুাবের ওপর। এছাড়াও মন্ত্রীর সাবেক এপিএস, মন্ত্রীর সকল পিএস, সচিবের পিএস, পিওন, পিও এমনকি মন্ত্র্ণালয়ের প্রভাবশাী পিওনরাও শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রেষণ/সংযুক্তির সুপারিশ করে থাকেন। শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা কাতর মিনতি করেন পিওনদের। আবার মন্ত্রণালয়ের গেটের বাইরে গিয়ে এই পিওনদেরই বকাঝকা করেন সরকারি কলেজ শিক্ষকরা। এমন সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ দৈনিকশিক্ষার হাতে রয়েছে।
সংযুক্তি/প্রেষণের জন্য মন্ত্রণালয়ের পিওনদের ঘুষ দেওয়া, পিএস এপিএসদের দপ্তরে দিনের পর দিন বসে থাকা। সেকায়েপের দুইজন নারী কর্মকর্তাকে দেখা যায় পিএসএস’র কক্ষে ঘুর ঘুর করতে। শিক্ষা ক্যাডারের কয়েকডজন কর্মকর্তাকে নানা উপঢৌকন নিয়ে মন্তী-সচিবের পিএস, পিও, পিওনদের টেবিলে টেবিলে যাওয়ার ছবি দৈনিকশিক্ষার হাতে রয়েছে।
সাবেক এপিএস কয়েকজন নারী শিক্ষককে প্রথমে ঢাকার বাইরে বদলি করে দিয়ে পরবর্তীতে নানা বিষয়ের বিনিময়ে ঢাকায় সংযুক্তি দিয়েছেন গত সাত বছর। এমন তথ্য প্রমাণ দৈনিকশিক্ষার হাতে রয়েছে।
আবার বি সি এস শিক্ষা সমিতির বিতর্কিত ও পরাজিত নেতা মাসুমে রাব্বানী খান ও বশির উল্লাহ গংরা ভোটরে আগে কাউকে কাউকে সংযুক্তির সুপারিশ করা আবার কাউকে বাতিল করার ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে।
চার হাজার শিক্ষকের পদ শূন্য: মাউশির হিসাব অনুযায়ী, ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের ৩১৬টি সরকারি কলেজে মোট ১৫ হাজার ২৮৯টি অনুমোদিত পদের মধ্যে ৩ হাজার ৭৫৪টি পদই শূন্য। প্রভাষক পদেই সবচেয়ে বেশি সংকট। এই পদে ৩ হাজার ১৩০টি পদে কোনো শিক্ষক নেই। এই পদে অনুমোদিত পদ আছে ৭ হাজার ৮০০। সহকারী অধ্যাপক পদ শূন্য আছে ৩০৯টি। সহকারী অধ্যাপকের অনুমোদিত পদ ৪ হাজার ২০০’র বেশি। সহযোগী অধ্যাপকের প্রায় আড়াই হাজার অনুমোদিত পদের মধ্যে ১২০টি শূন্য। আর অধ্যাপক নেই ১৯৫টি পদে। অধ্যাপকের অনুমোদিত পদের সংখ্যা ৮৩৪।
সূত্র: দৈনিক শিক্ষা