নিয়ম হচ্ছে যেকোনো সরকারি চাকরিতেই ৩০ শতাংশ পদে নিয়োগ পাবেন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যরা। কোনো চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সেই পদে লোক নিয়োগ বন্ধ থাকে। কারণ সংরক্ষিত কোটার পদে সাধারণ প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়া হয় না। আর দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় দিনের পর দিন পদ শূন্য থাকছে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে প্রশাসনিক কার্যক্রম। সাধারণ মানুষকে সেবা দেওয়ার মতো লোক পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থা প্রথম শ্রেণির ক্যাডার সার্ভিসেও। সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) সরকারকে জানিয়েছে, কারিগরি ও পেশাগত ক্যাডারের ক্ষেত্রে এই সমস্যা তীব্র। এ অবস্থায় আজ সোমবার মন্ত্রিসভা বৈঠকে কোটা সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হবে। বিশেষ করে ৩৪ ও ৩৫তম বিসিএসের কারিগরি বা পেশাগত ক্যাডারের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে তা সাধারণ প্রার্থীদের দিয়ে পূরণ করা হবে কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, কোটা সংরক্ষণের নিয়ম শিথিল করার প্রস্তাবে এরই মধ্যে সম্মতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু কোটা সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত যেহেতু মন্ত্রিসভায় নেওয়া হয়েছিল, তাই এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হলেও মন্ত্রিসভার অনুমোদন লাগবে। এ কারণেই বিষয়টি মন্ত্রিসভার আজ বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তত্কালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয় (বর্তমান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়) সরকারি ও আধাসরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধাস্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান এবং করপোরেশনের চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য নির্ধারিত কোটা পূরণ করা সম্ভব না হলে এসব পদ খালি রাখার বিষয়ে অফিস আদেশ জারি করেছিল।
পিএসসি এরই মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, ৩৫তম বিসিএসের এক হাজার ৮০৩টি শূন্য পদে লোক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। এসব পদের মধ্যে কারিগরি বা পেশাগত ক্যাডারের পদ এক হাজার ৩৪৮টি। মুক্তিযোদ্ধা কোটার শূন্যপদ সংরক্ষণে বিধিনিষেধ থাকায় যোগ্য প্রার্থীর অভাবে ৬০৬টি পদের অধিকাংশই পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। একই কারণে ৩৪তম বিসিএসের কারিগরি ও পেশাগত ক্যাডারের সংরক্ষিত ৬৭২টি পদও শূন্য রয়েছে। তাই ৩৪ ও ৩৫তম বিসিএসের কারিগরি ও পেশাগত ক্যাডারে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে অপূরণকৃত পদগুলো সাধারণ প্রার্থীদের জাতীয় মেধাতালিকার শীর্ষে অবস্থানকারী প্রার্থীদের দিয়ে পূরণ করার প্রস্তাব দিয়েছে পিএসসি। এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা মুক্তিযোদ্ধা কোটার শূন্যপদ সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত। ওই সিদ্ধান্ত শিথিল করার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে পিএসসি।
বর্তমানে প্রথম শ্রেণির চাকরিতে বেশির ভাগ পদই কোটার ভিত্তিতে পূরণ করা হয়। প্রথম শ্রেণির চাকরির মাত্র ৪৫ শতাংশ পূরণ হয় মেধার ভিত্তিতে। বাকি ৫৫ শতাংশই পূরণ করা হয় কোটার ভিত্তিতে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, মহিলা কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা ৫ শতাংশ এবং জেলা কোটা বা সাধারণ কোটা ১০ শতাংশ। পিএসসির কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী মহিলা ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটার পদ পূরণে সংরক্ষণজনিত কোনো বিধিনিষেধ নেই। শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটার পদ শূন্য রাখতে হয়। এই সংরক্ষণজনিত কারণে প্রতিটি বিসিএস পরীক্ষায় শূন্যপদ পূরণ করা যায় না। এতে শূন্যপদে দ্রুত নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা ব্যাহত হচ্ছে। এসব কারণেই সরকারের প্রায় আড়াই লাখ পদ শূন্য রয়েছে।
সাবেক সংস্থাপন (বর্তমান নাম জনপ্রশাসন) সচিব ড. মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের প্রজন্মকে যথাযথ সম্মান দেওয়া দরকার। এতে কারো দ্বিমত করার সুযোগ নেই। এটা রাষ্ট্রের কর্তব্য। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে তত দিন তাদের সম্মান করতে হবে। কিন্তু সিভিল সার্ভিসে পেশাদারি আনার জন্য মেধাবীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার সময় এসেছে। শুধু চাকরি দিলেই সম্মান হয় না। নানাভাবে সম্মান করা যায়। উন্নয়নের স্বার্থে, প্রতিযোগিতার স্বার্থে শুধু কারিগরি নয়, সব ক্যাডারেই মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ করা উচিত। এখানে ভুল বোঝাবুঝির কোনো সুযোগ নেই। অতীতে বিভিন্ন কমিশনও মেধার ভিত্তিতে লোক নিয়োগের সুপারিশ করেছে।
আওয়ামী লীগ আমলে ১৯৯৮ সালে শামসুল হক কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিশনও কোটা পদ্ধতি সংস্কারের সুপারিশ করেছিল। কমিশন বলেছিল, দীর্ঘকাল ধরে সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থায় জেলা কোটার সুবাদে উত্কৃষ্টদের ডিঙিয়ে নিম্নমেধার লোকেরা নিয়োগ লাভের সুযোগ পাচ্ছে। তাই কর্মজীবনে মেধাভিত্তিক উন্নতির জন্য এ সূচনা অশুভ হতে বাধ্য। সরকারি কর্মকমিশন তাদের বার্ষিক রিপোর্টগুলোতে মেধানীতির অনুকূলে কোটাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার জন্য বারবার সুপারিশ করেছে। কিন্তু তাদের সুপারিশের ব্যাপারে এখনো কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে দক্ষতা বা কার্যকারিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের অভিমত হচ্ছে, শুধু মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের সর্বাত্মক চেষ্টা চালানোর সময় এসেছে। অত্যন্ত সীমিতসংখ্যক পদে একটা নির্ধারিত সময়ের জন্য মহিলা ও পশ্চাত্পদ জনগোষ্ঠীর লোকদের কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ করা যেতে পারে। এরই মধ্যে কোটা যাতে পুরোপুরি বিলোপ করা যায় সে জন্য তাদের অগ্রগতি অর্জনের সুযোগ দিতে হবে। সমাজের সব শ্রেণির জন্য সুযোগের সমতা ও দক্ষতা বিকাশ ঘটানোর জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করার পরিবর্তে কোটা পদ্ধতি রাখা হবে একটি অত্যন্ত দুর্বল বিকল্প।
সূত্র: কালের কণ্ঠ