এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য কেবল ভালো মানের পাঁচটি কলেজের নাম পছন্দক্রম দেওয়ায় তাদের অনেকে এখনো ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না। অন্যদিকে পছন্দক্রমে নাম না থাকায় এক হাজারের বেশি কলেজ পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী পাচ্ছে না। শিক্ষার্থী পেতে এসব কলেজ শিক্ষা বোর্ডের কাছে ধরনা দিচ্ছে।
চার দফায় সময় বাড়িয়ে গত ২৮ জুন মধ্যরাতের পর একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য মনোনীত শিক্ষার্থীদের প্রথম মেধাতালিকা প্রকাশ করে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। তালিকা প্রকাশের পর বিভিন্ন ধরনের ভুল-ভ্রান্তি বের হয়। গত সোমবার দ্বিতীয় মেধাতালিকা প্রকাশের পরও ভর্তি নিয়ে জটিলতা কাটেনি। এবার দুই ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় তালিকাতেও সারা দেশের ৫২ হাজার ১২৪ জন ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী কোনো কলেজে ভর্তির জন্য মনোনীত না হওয়ায় সমস্যায় পড়েছে। কারণ, ভালো কলেজ, এমনকি দ্বিতীয় সারির কলেজগুলোতেও এখন কার্যত আর শূন্য আসন নেই।
গতকাল ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শকের কার্যালয়ের সামনে কথা হয় পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার থেকে আসা সবুজ পালের সঙ্গে। জিপিএ-৫ পাওয়া সবুজ জানায়, সে নটর ডেম কলেজ (এই কলেজে অনলাইনে ভর্তির সুযোগ নেই), বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ কলেজ, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা সিটি কলেজে ভর্তির জন্য পছন্দক্রম দিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় দফাতেও কোনো কলেজে ভর্তির জন্য সে মনোনীত হয়নি। এখন দ্বিতীয় সারির কলেজেও আসন নেই। ভালো ফল করেও এখন তাকে নিম্নমানের কলেজে ভর্তি হতে হবে।
রাজবাড়ী থেকে আসা শাহজাহান আলী জানান, তাঁর ছেলে সিফাত-ই মো. জিসান জিপিএ-৫ পেয়েছে। সে ঢাকার রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ ও বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু মনোনীত হয়নি। এখন কোথায় ভর্তি করাবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।
ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু বক্কর ছিদ্দিক বলেন, দ্বিতীয় তালিকায় যেসব শিক্ষার্থী মনোনীত হয়নি, তাদের প্রায় সবাই ভালোমানের কলেজে ভর্তির জন্য পছন্দক্রম দিয়েছিল। মনোনীত না হওয়া শিক্ষার্থীদের এখন শূন্য আসন থাকা কলেজে ৯ ও ১০ জুলাই নতুন করে আবেদন করতে হবে।
ঢাকা বোর্ডের কম্পিউটার শাখার একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পর্যালোচনায় দেখা গেছে, জিপিএ-৫ পাওয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থী উত্তরা রাজউক মডেল কলেজ, ঢাকা কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ কলেজ, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, ঢাকা কমার্স কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ এবং চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনাসহ বিভাগীয় শহরের নামকরা কলেজে ভর্তির জন্য পছন্দক্রম দিয়েছিল। কিন্তু এসব ভালো কলেজে আসন আছে সব মিলে প্রায় ২০ হাজারের মতো। অথচ সারা দেশে এবার ১০ বোর্ডে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লাখ ১১ হাজার ৯০১ জন।
রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের রায়ের কারণে নটর ডেম, হলিক্রস ও সেন্ট যোসেফ কলেজ অনলাইনে ভর্তির কার্যক্রমের বাইরে। এ তিনটি কলেজ পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করছে। তবে কিছু শিক্ষার্থী এসব কলেজের নামও পছন্দক্রমে দিয়েছে।
শিক্ষার্থী-সংকট সহস্রাধিক কলেজ: ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু বক্কর ছিদ্দিক গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, এবার প্রায় ২০০ কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন করেছে মাত্র এক থেকে পাঁচজন করে শিক্ষার্থী। আর ৯৯৯টি কলেজে আবেদন করেছে ১ থেকে ২০ জন করে শিক্ষার্থী।
ঢাকা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শকের কার্যালয়ে গতকাল এসেছিলেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ঢাকা এডিনবার্গ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ রোকেয়া রুমি। তিনি বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক আশফাকুস সালেহীনকে বলেন, প্রথম দফায় তাঁর কলেজে মাত্র ছয়জন শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু ভর্তি হয়েছে দুজন। ভেবেছিলেন দ্বিতীয় তালিকায় শিক্ষার্থী পাবেন। কিন্তু একজনও মনোনীত হয়নি। তাই তিনি শিক্ষার্থী চেয়ে গতকাল কলেজ পরিদর্শকের কাছে আবেদন করেন। কিন্তু নতুন নিয়মের কারণে কলেজ পরিদর্শক তাঁকে কোনো আশা দিতে পারেননি।
রোকেয়া রুমি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষার্থী পাচ্ছি না। এখন কলেজ চালাব কী করে?’
ময়মনসিংহের বিদ্যাগঞ্জ এলাকার ফকির সোহরাব আলী কলেজের একজন শিক্ষকও বোর্ডে এসেছিলেন একই কারণে। তিনি বলেন, তাঁদের কলেজে ৩০০ আসন অনুমোদিত। কিন্তু আবেদন করেছে খুবই কম।
ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছেও একজন শিক্ষক একই রকম সমস্যা নিয়ে আসেন।
তালিকাভুক্তদের ভর্তি না করানোর অভিযোগ: ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির দ্বিতীয় মেধাতালিকাভুক্ত ও কলেজ পরিবর্তন হওয়া (মাইগ্রেশন) শিক্ষার্থীদের ভর্তি না করানোর অভিযোগ উঠেছে। দ্বিতীয় তালিকায় সুযোগ পাওয়া ছাত্রীরা গতকাল সকালে ভর্তি হতে ভিকারুননিসা কলেজে যায়। তাদের অভিযোগ, কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের ভর্তি করেনি। এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা বেইলি রোডে কলেজের সামনে অবস্থান নেন। তাদের অবস্থান এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ঢাকা বোর্ডের চাপের মুখে বিকেলে ছাত্রীদের ভর্তি করাতে রাজি হয় কর্তৃপক্ষ।
বিকেলে কলেজের অধ্যক্ষ সুফিয়া খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সরকারের আইনকানুন মেনে চলবেন।
এই কলেজে মাইগ্রেশন পাওয়া একজন ছাত্রীর বাবা পরে প্রথম আলোকে বলেন, কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আজ বুধবার সকাল ১০টায় ভর্তি নেওয়া হবে।
মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের ভর্তি-ইচ্ছুক একজন শিক্ষার্থীর স্বজন প্রথম আলোকে বলেন, দ্বিতীয় মেধাতালিকাভুক্ত হলেও এই কলেজে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না।
এ বিষয়ে ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রথম আলোকে বলেন, তালিকাভুক্ত শিক্ষার্থীরা যাতে ভর্তি হতে পারে, তার ব্যবস্থা তিনি করবেন।
এদিকে কলেজ পরিবর্তন হওয়া শিক্ষার্থীদের অনেকে ভর্তি হওয়ার আগের কলেজ থেকে ভর্তির টাকা ফেরত পাচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, সংশ্লিষ্ট কলেজগুলোর প্রতি আহ্বান থাকবে, তারা যেন এমন শিক্ষার্থীদের ভর্তির টাকা ফেরত দেয়।