‘সব সাবজেক্ট আয়ত্ত করতে পারলেও বাংলা সাহিত্যে এসে আটকে যেতাম। এ বিষয়টা তাই বারবার পড়তাম, পড়তাম ভুলে যেতাম। আবার পড়তাম, আবার ভুলে যেতাম। তবু বারবার চেষ্টা করতাম। আর যে কাজটা সবচেয়ে বেশি করেছি সেটা হল গ্রুপ স্টাডি। এই গ্রুপ স্টাডিটাকে আমি একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। বন্ধুরা একসঙ্গে বসে পরীক্ষা দিতাম আর দেখতাম কে কোন সাবজেক্টে বেশি নম্বর পাচ্ছে। সেভাব টার্গেট ধরেই পড়তাম। কেউ বেশি নম্বর পেলে মনে হত, আমাকে ওর থেকে বেশি পেতেই হবে। নম্বরের দিক থেকে তাকে ছাড়িয়ে যেতে হবে।’
বলছিলেন ৩৩ তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে প্রথম স্থান অধিকারী তানভীর হোসেইন। চ্যানেল আই অনলাইনকে দেয়া সাক্ষাকারে বলেছেন জীবনের গল্প। বিসিএস পরিক্ষার্থীদের জন্য দিয়েছেন দিক নির্দেশনা।
চার ভাইবোনের মধ্যে তানভীর তৃতীয়। রাজধানীর মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০১ সালে জিপিএ ৪.২০ পেয়ে এসএসসি ও নটরডেম কলেজ থেকে ২০০৩ সালে ৪.৭৫ পেয়ে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে।
বাবা মায়ের ভক্ত এই তরুণ আজীবন মা-বাবার পরামর্শ মতই চলেছেন। জীবনে যখন যে সময়টা সামনে এসেছে সেটাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন।
তবে ‘ডিফেন্সে’ যাবার ইচ্ছাটা সেই ছোট থেকেই ছিল এই পুলিশ কর্মকর্তার। সেই সঙ্গে বাবার অনুপ্রেরণা। তানভীরের বাবা ছিলেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক। সবসময়ই চাইতেন চার সন্তানের মধ্য থেকে কেউ সরকারের কর্মকর্তা হবে।
বাবা বলতেন, ‘আমার পর কে সত্যায়িত করবে!’ বাবার এই ইচ্ছাটা পূরণ হয় তানভীরকে দিয়েই। আর তাই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেও বাবার ইচ্ছা পূরণ আর নিজের মনে লালিত স্বপ্নটা থেকেই দেন বিসিএস।
সরকারি কর্মকর্তার সন্তান হওয়ায় খুব কাছ থেকেই দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন বাবার ও বাবার বন্ধুদের জীবন যাপনের ধরণ। নিয়মিত যাতায়াত ছিল বাবার পুলিশ কর্মকর্তা বন্ধুদের বাসায়। তাদের জীবন যাপনের স্টাইল, পোশাক, চলাচলনে আকৃষ্ট হন তিনি। সেটাও তার প্রকৌশলী পেশা ছেড়ে বিসিএস দিয়ে পুলিশে আসার পেছনে অন্যতম কারণ।
বুয়েটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে বিএসসি শেষ করে ভর্তি হন এমএস-এ। এক বছর এমএস আর সেই সঙ্গে নিতে থাকেন বিসিএসের প্রস্তুতি।
শুরুটা ৩০তম বিসিএস দিয়ে। প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় সফল হলেও আটকে যান ভাইভাতে। পুনরাবৃত্তি ঘটে ৩১তম বিসিএসে। সেখানেও বাদ পড়েন ভাইভায়। তবে দৃঢ় মনোবল আর নিজের প্রতি আস্থা থাকায় পিছপা হননি কখনোই।
আবারও প্রস্তুতি নিয়ে দেন ৩৩ তম বিসিএস। তবে এবারে আর ব্যর্থতা নয়। তীব্র প্রতিযোগিতায় লাখ লাখ পরিক্ষার্থীকে পেছনে ফেলে একেবারে প্রথম স্থান অধিকার করেন বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে।
তানভীর বলেন, ‘আমি যে প্রথম হয়েছি এটা আমি জানতাম না। ফলাফলের দিন দুপুরবেলা আমার খুব কাছের বন্ধু শাহরিয়ার আমাকে ফোন করে জানিয়েছিল বিষয়টা। অনেক ভাল লেগেছিল যখন জানতে পারি আমি সফল হয়েছি। আরও ভাল লাগে যখন বন্ধুরা সবাই ফোন করে বলতে থাকে প্রথম হবার কথা। সে এক অন্যরকম অনুভূতি যা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।’
ফল প্রকাশের পর বুনিয়াদী প্রশিক্ষণে অংশ নিতে যান সারদার পুলিশ একাডেমিতে। তবে পুলিশে প্রথম হওয়ায় তানভীরের দায়িত্ব ছিল অন্যদের থেকে অনেক বেশি। কোড সিনিয়র হওয়ায় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগসহ সব দায়িত্ব পালন করতে হত এ কর্মকর্তাকে।
‘আর তাই সবাইকে বলব, বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে আসো কিন্তু প্রথম হয়ো না,’ হেসে বলেন তানভীর।
তবে প্রথম হওয়ায় যে সম্মানটা পেয়েছেন সেটাও বেশ উপভোগ করেন তিনি।
ট্রেনিং এর অংশ হিসেবে ফরিদপুরে যোগ দেন শিক্ষানবিশ সহকারি পুলিশ সুপার হিসেবে। সে সময়গুলোর কথা মনে হলে এখনও অনন্দে উদ্বেলিত হন তিনি। উপলব্ধি করতে পারেন একজন কর্মকর্তার জীবনের বিষয়টি। আনন্দিত হন রাতারাতি নিজের জীবনের পরিবর্তন দেখে। সম্মানসহ সবকিছুকেই উপভোগ করতে থাকেন ভেতর থেকে।
শিক্ষানবিশ সময় শেষ হবার পরই যোগ দেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে সহকারি পুলিশ কমিশনার হিসেবে। বর্তমানে কর্মরত অাছেন রাজারবাগে।
চাকুরিজীবনে বিভিন্ন সময়ে হতে হয়েছে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তবে সাহস, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা দিয়ে জয় করেছেন সব।
খেলাধুলাপ্রিয় হাস্যোজ্জ্বল পুলিশের এই কর্মকর্তা সহজ সরল জীবনে অভ্যস্ত। সময় কাটাতে পছন্দ করেন পরিবারের সঙ্গে। পছন্দ ক্রিকেট আর টেনিস। তাই খেলার সুযোগ মিললে হাতছাড়া করেন না কখনই।
বিসিএস পরীক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন: প্রিলিমিনারি ও রিটেনের জন্য আলাদা আলাদা না পড়ে একসঙ্গে সমন্বিত প্রস্তুতি নিতে হবে। যে বিষয়টা পড়তে হবে সেটা পুরোপুরি জানতে হবে। তাহলে যেভাবেই প্রশ্ন আসুক না কেন উত্তর দেয়া যাবে। নিজের দুর্বল পয়েন্টগুলো খুঁজে বের করতে হবে। বাবরবার অনুশীলন করতে হবে সেগুলো। প্রিলিমিনারির ক্ষেত্রে উত্তর দেয়ার সময় এলিমিনেশন পদ্ধতিটা অনেক বেশি কার্যকরী।
‘রিটেনের ক্ষেত্রে যত বেশি ডাটা, চার্ট ব্যবহার করা যায় প্রশ্নের উত্তর তত সমৃদ্ধ হয়। আর রিটেনে ভাল করার জন্য ঘড়ি ধরে বেশি বেশি লেখার অভ্যাস খুব কার্যকরী।’
মৌখিক পরিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ভাইভাতে সবচেয়ে জরুরি আই কন্টাক্ট। প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় এদিক সেদিক না তাকিয়ে সরাসরি প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়াটা শ্রেয়। প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকলেও কোন নেগেটিভ উত্তর না দিয়ে সেটাকেও পজিটিভলি উত্তর দিতে পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা।
চ্যানেল আই অনলাইনের মাধ্যমে সব বিসিএস পরিক্ষার্থীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন: আস্থা ও বিশ্বাস, সেই সঙ্গে শ্রম দিলে সফলতা আসবেই।
সূত্র: চ্যানেল আই