১১৯ বছরের পুরনো স্কুল বগুড়া জেলা সদরের ১ নম্বর টেংরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এক যুগ আগেও সেখানে গড়ে ৭০০ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করত। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা নেমেছে ১০৫ জনে। বর্তমানে যে চারজন শিক্ষক আছেন, তাঁরা যোগ দেওয়ার আগে থেকেই স্কুল ভবনটি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। পলেস্তারা খসে পড়েছে, রড বেরিয়ে গেছে। চারটি শ্রেণিকক্ষ একেবারেই তালাবদ্ধ। অন্য দুটির একটিতে অফিস, অন্যটিতে ঝুঁকি নিয়ে শুধু পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস চলছে। অন্য ক্লাসগুলো হয় বারান্দা আর মাঠে। বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আছেফা বেগম বলেন, ‘আমরা বলেই যাচ্ছি, আর সবাই শুনেই যাচ্ছেন। ভবন আর হচ্ছে না। ঝড়বৃষ্টিতে ক্লাস করানো যায় না। অভিভাবকরাও বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে চান না। দিন দিন শিক্ষার্থী কমছে। অথচ কারো কোনো নজর নেই।’
ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলার রাখালগাছি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৭২। ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এ স্কুলে তখন দুই রুমের একটি ভবন তৈরি করে দিয়েছিল সরকার। তবে সেটি ২০০৭ সালে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে আকাশের নিচে চলছে পাঠদান। বৃষ্টির সময় পরিত্যক্ত ভবনের একটি রুমে গাদাগাদি করে থাকে শিশুরা। সে সময় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধই থাকে। বেঞ্চগুলো ভেঙেচুরে গেছে অনেক আগেই। শিক্ষক ও গ্রামবাসী মিলে ২০টি বেঞ্চ তৈরি করে দিয়েছেন; কিন্তু তাতে একটি শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরও বসার জায়গা হয় না। ফলে মাটিতে বসেই ক্লাস করতে হচ্ছে শিশুদের। স্কুলটিতে নেই বাথরুম। একমাত্র টিউবওয়েলটিও কয়েক বছর ধরে নষ্ট। বিদ্যালয়ের এমন করুণ হালে দিন দিন কমছে শিক্ষার্থী। অথচ ওই ইউনিয়নের দহিসারা, রাখালগাছি ও তারাকান্দি জেলেপাড়ার শিশুদের পড়ালেখার একমাত্র স্কুল এটি।
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক পারভীন সুলতানা বলেন, ‘আমাদের স্কুল নিয়ে শিক্ষা অফিসারদের বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। আসলে এটি যে স্কুল, তা বলে না দিলে কেউ বুঝতেই পারবেন না। বেঞ্চ নেই। ব্ল্যাকবোর্ডসহ অন্যান্য যেসব উপকরণ ছিল, তাও চুরি হয়ে গেছে। আমরা শিক্ষার্থীদের রোদ-বৃষ্টির মধ্যে দাঁড় করিয়ে যে পড়ালেখা করাই, এটাকে শিক্ষাদান বলে না।’ স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি হাফিজুর তালুকদার বলেন, ‘গত ২০ মে বিদ্যালয়ের পরিস্থিতি জানাতে প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে গিয়েছিলাম। তাঁরা বলছেন, আপনাদের ভবন তালিকার ২ নম্বরে আছে। এই একই কথা আট বছর ধরে বলে আসছেন শিক্ষা কর্মকর্তারা। স্কুলটা নামেই সরকারি। শিক্ষকদের শুধু বেতন দেয় সরকার। এর বাইরে এক পয়সারও অবদান নেই তাদের। এভাবে পড়ালেখা হয়? আমরা চাঁদা তুলে শিক্ষাদান অব্যাহত রেখেছি।’ শুধু টেংরা আর রাখালগাছি বিদ্যালয় নয়, সারা দেশে এমন জীর্ণশীর্ণ ও পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা ৯ হাজার বিদ্যালয়ের তালিকা তৈরি করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এসব নড়বড়ে প্রতিষ্ঠানেই চলছে শিক্ষার প্রাথমিক ভিত গড়ার কাজ। এ তো গেল অবকাঠামোগত পরিস্থিতি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে চরম শিক্ষক সংকট। দুইয়ে মিলে দেশের আগামী প্রজন্মের প্রাথমিক শিক্ষার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে বলে অভিমত শিক্ষাবিদদের।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের উপপরিচালক হুমায়ন কবির বলেন, ‘৯ হাজার বিদ্যালয়ের ভবন জরুরি ভিত্তিতে তৈরির জন্য আমরা তালিকা বানিয়েছি। অর্থ বরাদ্দ পেলেই কাজ শুরু হবে। ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে যেসব বিদ্যালয়ের কথা আপনারা বলছেন, সেগুলো এই তালিকায় আছে।’ ২০১২ সাল পর্যন্ত দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৬ হাজার। ২০১৩ থেকে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আরো ২৬ হাজার। সাত বছর ধরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ। ফলে পুরনো সেই ৩৬ হাজার বিদ্যালয়ের ১৫ হাজারেই নেই প্রধান শিক্ষক। বেশির ভাগ স্কুলেই শিক্ষক সংখ্যা চারজন। প্রধান শিক্ষক না থাকলে বাকি তিনজনের মধ্য থেকে একজনকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে হয়। ব্যস্ত থাকতে হয় প্রশাসনিক এবং সরকারি ও স্থানীয় নানা কাজে। ফলে দুজনকেই মূলত চালাতে হয় ক্লাস। একটি স্কুলে প্রাক-প্রাথমিকের ক্লাসের সময় আড়াই ঘণ্টা। আর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে চারটি ক্লাস এবং তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৪৫ মিনিটের ছয়টি ক্লাস হওয়ার কথা। কিন্তু দুজন শিক্ষকের পক্ষে এত ক্লাস নেওয়া আদৌ সম্ভব নয়। কোনো রকমে এসব স্কুলে সিলেবাস শেষ করানো হলেও শিশুরা আসলে কতটুকু শিখছে, সে প্রশ্ন শিক্ষাবিদদের।
বগুড়া জেলার কুড়াহারহাট সূর্যতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক মাত্র তিনজন। তাঁদের মধ্যে আবদুল হান্নান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে। তিনি বলেন, ‘খুবই সমস্যা হচ্ছে। ঠিকমতো ক্লাস নেওয়া যাচ্ছে না। আমাকে বেশির ভাগ সময় সরকারি কাজে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। আবার একজন শিক্ষক অনেক সময় ছুটিতেও থাকেন। প্রাক-প্রাথমিকে আড়াই ঘণ্টার ক্লাস এবং প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রতিদিন চারটি আর তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে ছয়টি ক্লাস হওয়ার কথা। কিন্তু শিক্ষক স্বল্পতায় একজনকেই একসঙ্গে দুটি ক্লাস চালাতে হচ্ছে। একসঙ্গে একাধিক বিষয় পড়াতে হচ্ছে।’ ২০১৩ সালে জাতীয়করণ হওয়া স্কুলগুলোর শিক্ষকদের মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষাবিদরা। কারণ এসব স্কুলের বেশির ভাগ সহকারী শিক্ষকই এসএসসি পাস আর প্রধান শিক্ষকরা উচ্চ মাধ্যমিক। সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা একবার প্রশিক্ষণ পেলেও তাঁদের অনেকেরই তা নেই। অথচ সব স্কুলই এখন একই কাতারে এসেছে। তাই শিক্ষার মান বাড়াতে এসব স্কুলের শিক্ষকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ জরুরি বলে অভিমত শিক্ষাবিদদের।
জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এখনই ইউরোপ-আমেরিকার মতো মান আশা করলে হবে না। আমাদের মতো করেই মান চাইতে হবে। আমাদের প্রাথমিক স্কুলে এখন বিএ-এমএ পাস শিক্ষকের সংখ্যাই বেশি। তাঁরা যদি তাঁদের পুরো দক্ষতার প্রয়োগ ঘটান, তাহলে শিক্ষার মান আরো বাড়বে। তবে দুর্গম এলাকায় কিছু সমস্যা আছে। সেখানে শিক্ষকরা অতটা মনোযোগী নন। শিক্ষকদের আন্তরিকতারও কিছুটা অভাব রয়েছে। তাঁদের আরো দরদি হতে হবে। আর অন্য দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের বেতন কাঠামো তুলনা করলে চলবে না। এর পরও আমরা ২০১৩ সালে ২৬ হাজার স্কুল নতুন করে জাতীয়করণ করেছি। বেতনও বেড়েছে। প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণিতে তোলা হয়েছে। শিক্ষকরা এখন যা পাচ্ছেন আগে তো তাও পেতেন না। আমরা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। আর মান কখনোই রাতারাতি বাড়ানো সম্ভব নয়।’