ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলার হাজেরা খাতুন রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্যানেল শিক্ষক হিসেবে সরকারের তালিকাভুক্ত হন। কিন্তু সরকার তাঁকে নিয়োগ দেয়নি। তাই তিনি হাইকোর্টে রিট করেন। আদালত তাঁকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি নির্দেশ দেন। রায়ের কপি প্রকাশের ৬০ দিনের মধ্যে নিয়োগ দিতে বলা হয়। কিন্তু তিনি এখনো নিয়োগ পাননি।
শুধু হাজেরা খাতুন নন, আরো অনেকের ক্ষেত্রে এমন হয়েছে। ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার মোখলেসা খাতুন ও মামুনুর রশিদ, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ঝর্ণা আক্তার, সাতক্ষীরা সদরের মনিরুজ্জামান, বগুড়া সদরের মোস্তফা কামালসহ সারা দেশে প্রায় ১৩ হাজার প্যানেল শিক্ষক নিয়োগ পাননি। তাঁদের বেশির ভাগের পক্ষে উচ্চ আদালতের নিয়োগ-সংক্রান্ত নির্দেশ রয়েছে।
সরকারের হিসাবে এখনো নিয়োগ পাননি এমন প্যানেল শিক্ষকের সংখ্যা ৯ হাজারের বেশি নয়। হিসাবের গরমিলের কারণে তাঁদের নিয়োগ না দেওয়ায় সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ ভেস্তে যেতে বসেছে। উপেক্ষিত হচ্ছে উচ্চ আদালতের রায়ও। এ অবস্থায় নিয়োগবঞ্চিতরা শিক্ষাসচিব, জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে (অর্থাৎ সরকারের বিরুদ্ধে) হাইকোর্টে আদালত অবমাননার মামলা করার প্রস্তুতি নিয়েছেন। আন্দোলনের হুমকিও দিয়েছে তাঁরা।
প্রসঙ্গত, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনে সরকার সদ্য জাতীয়করণ করা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গত জুনে প্রায় ১৯ হাজার প্যানেল শিক্ষককে নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু অনেকে নিয়োগ না পাওয়ায় সরকারের সাফল্য ম্লান হতে যাচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আলমগীর বলেন, এখনো যাঁরা নিয়োগ পাননি তাঁদের অপেক্ষা করতে হবে। সদ্য জাতীয়করণ করা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পদ শূন্য হলে পর্যায়ক্রমে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হবে। সে পর্যন্ত তাঁদের অপেক্ষা করতে হবে। প্যানেলভুক্ত শিক্ষকদের পক্ষে উচ্চ আদালতে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী সিদ্দিকউল্লাহ মিয়া বলেন, ২২ হাজার রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৯০ হাজার শিক্ষকের পদ খালি রয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পর সরকার প্রায় ১৯ হাজার প্যানেল শিক্ষককে নিয়োগ দিয়েছে।
আরো অনেক পদ খালি রয়েছে। তাই বাকিদের নিয়োগ দিতে সরকারের সমস্যা থাকার কথা নয়। তিনি বলেন, খোঁজ করলে দেখা যাবে, কয়েক হাজার প্যানেলভুক্ত শিক্ষক অন্য চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। কেউ বা মারা গেছেন। শেষ পর্যন্ত তিন-চার হাজার লোকের নিয়োগের প্রয়োজন পড়বে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের আগেই সরকার তাঁদের নিয়োগ দিতে পারে। এটা হলে সরকারের মহৎ একটি উদ্যোগ পুরোপুরি সফল হবে। সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো স্বস্তি পাবে। উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ১১ এপ্রিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি করে।
পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ ৪২ হাজার ৬১১ জনকে নিয়োগের জন্য একটি প্যানেল গঠন করা হয়। তাঁদের মধ্যে ১০ হাজার ৪৯৭ জনকে নিয়োগ দেয় সরকার। যদিও ঘোষণা ছিল, সবাইকে নিয়োগ দেওয়া হবে। পরে নতুন করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করে সরকার। ২০১২ সালের ২১ মার্চ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে জারি করা পরিপত্রে বলা হয়, উপজেলাভিত্তিক নয়, ইউনিয়নভিত্তিক নিয়োগ হবে। এ অবস্থায় নওগাঁ জেলার দশজন নিয়োগবঞ্চিত শিক্ষক ইউনিয়নভিত্তিক নিয়োগের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এবং তাঁদের নিয়োগের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন। ২০১৪ সালের ১৮ জুন হাইকোর্ট আবেদনকারী ১০ জনকে নিয়োগ দিতে সরকারকে নির্দেশ দেন এবং ইউনিয়নভিত্তিক নিয়োগের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে সরকার লিভ টু আপিল আবেদন করে। এ আবেদন গত বছরের ৭ মে খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। এরপর সরকার রিভিউ আবেদন করে। গত ১১ ফেব্রুয়ারি তা খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত। এরপর নওগাঁর ১০ জনকে নিয়োগ দিতে বাধ্য হয় সরকার।। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে সরকার ২২ হাজার ৯২৫টি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করে। এরপর প্যানেল থেকে নিয়োগ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। নিয়োগবঞ্চিত প্যানেল শিক্ষকরা আন্দোলনে নামেন। অনেকে হাইকোর্টে রিট করেন। ফলে সরকার বিপাকে পড়ে—মামলা মোকাবিলা করবে, নাকি নিয়োগ দেবে। শেষ পর্যন্ত আইনি জটিলতা এড়াতে সরকার প্যানেলভুক্তদের নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। গত ১৮ মে সদ্য জাতীয়করণ করা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগের নির্দেশ দেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ৬ জুন শূন্য পদে নিয়োগের জন্য অফিস আদেশ জারি করে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের মধ্যে সব শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হবে। জানা গেছে, ৬ জুনের পর থেকে এ পর্যন্ত ১৮ হাজার ৭৩১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখনো নিয়োগ পাননি ১৩ হাজার ৩৭৩ জন। তবে শূন্য পদের এ সংখ্যা নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। সূত্র: দৈনিক শিক্ষা