পাঠ্যবই মুদ্রণ সঙ্কট ঘনীভূত

বিশ্বব্যাংকের শর্তযুক্ত চিঠি গ্রহণ করেননি সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে নির্বাচিত বাংলাদেশী মুদ্রণ শিল্প মালিকেরা। গতকাল তারা চিঠি আনার জন্য যান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এনসিটিবিতে। কিন্তু এনসিটিবির সাথে দীর্ঘ বৈঠকের পর তারা সবাই চিঠি না নিয়ে ফেরত যান খালি হাতে। দরপত্রের বাইরে বিশ্বব্যাংকের শর্তযুক্ত চিঠিকে তারা অসম্মানজনক ও বেআইনি হিসেবে আখ্যায়িত করে তা নিতে অস্বীকৃতি জানান। শুধু তা-ই নয়, তারা এ নিয়ে আইনি লড়াইয়ের হুমকি দিয়েছেন।

6-Ctg-Book-1-copy

ফলে প্রাথমিকের সাড়ে ১১ কোটি পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা আরো ঘনীভূত হলো। এনসিটিবি চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র পাল নয়া দিগন্তকে বলেন, যেহেতু তারা হাতে চিঠি গ্রহণ করেননি, তাই ডাকযোগে আজ (বৃহস্পতিবার) তাদের চিঠি পাঠানো হবে। মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতৃবৃন্দ জানান, ডাকযোগে চিঠি পাঠালে, সেই কপি নিয়ে প্রয়োজনে আদালতের দ্বারস্থ হবেন। কারণ বিশ্বব্যাংকের দাবি অনুযায়ী যে শর্ত দিয়ে তাদের চিঠি দেয়া হচ্ছে, তাতে তাদের জন্য বই ছাপার কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। আর নতুন করে শর্তারোপ টেন্ডার নীতিমালার নীতিবহির্ভূত। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে ভারতের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে দেশী মুদ্রণ শিল্প মালিকদের কাছ থেকে। কেননা বিগত বছর ভারত মুখ্য টেন্ডার বিজেতা হওয়ায় বিশ্বব্যাংক কোনো বাদ সাধেনি। এমনকি তখন তারা কোনো শর্তও দেয়নি। এবার ভারত টেন্ডারে সর্বনিম্ন দরদাতা না হতে পারায় বিশ্বব্যাংকের নেতিবাচক ভূমিকায়ই এ ভয়াবহ জটিলতা সৃষ্টির প্রধান কারণ হিসেবে এরই মধ্যে চিহ্নিত হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে গতকাল সমিতির নেতৃবৃন্দ বলেন, বৈঠকে এনসিটিবির পক্ষ থেকে তাদের বলা হয় তারা চিঠি গ্রহণ করলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী তাদের সাথে বৈঠকে বসবেন। চিঠি না নিলে তিনি বৈঠকে বসবেন না। তারা বলেন, চিঠি নেয়ার পর মন্ত্রীর সাথে বৈঠক করে কী হবে। তিনি কি দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন করতে পারবেন? বৈঠক যদি করতে হয় তাহলে আগে করতে হবে, পরে নয়। আমরা শর্ত মেনে চিঠি নেয়ার পর বৈঠক করে কোনো ফায়দা নেই।

প্রাথমিকের পাঠ্যবই ছাপার কাজ দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে দেয়ার ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে নতুন করে শর্তারোপের পর থেকে সৃষ্ট জটিল পরিস্থিতি নিরসনে এনসিটিবির পক্ষ থেকে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান মালিকদের সাথে। চিঠি দেয়ার আগে এনসিটিবি চেষ্টা করেছে তাদের বুঝিয়ে রাজি করাতে। এরই অংশ হিসেবে গতকালও ডাকা হয়েছিল তাদের। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের শর্তের বিষয়ে বাংলাদেশী মুদ্রণ শিল্প মালিকেরা তাদের অবস্থানে অনড় থাকায় শেষ পর্যন্ত কোনো ফলাফল ছাড়াই শেষ হলো বৈঠক এবং চিঠি না নিয়ে ফিরে এলেন তারা। এর ফলে আগামী বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নির্ধারিত সময়ে পাঠ্যবই বিতরণ কার্যক্রম মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ল। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সময়মতো বই না পৌঁছানোর দায় বিশ্বব্যাংক নয় সরকারকেই নিতে হবে।

new-book-festival

বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত এনসিটিবির সাথে বৈঠক শেষে নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা পাঠ্যবই ছাপার কাজ করার জন্য অপেক্ষা করে আছি। আমরা আশা করছি এনসিটিবি আমাদের বেআইনি শর্তযুক্ত চিঠি পাঠাবে না। এটি অসম্মানজনক ও আইনের পরিপন্থী। আমরা বই ছাপার কাজ করতে চাই। কিন্তু এনসিটিবি আমাদের বিশ্বব্যাংকের শর্তযুক্ত যে চিঠি দিতে চেয়েছে, তা আমাদের জন্য অপমানজনক বিধায় আমাদের পক্ষে নেয়া সম্ভব হয়নি।

মুদ্রণ শিল্প সমিতির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তোফায়েল খান বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে এনসিটিবির কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে কোন আইনের বলে আপনারা আমাদের বিশ্বব্যাংকের শর্তযুক্ত এ চিঠি দিচ্ছেন। বাংলাদেশের কোন আইন বা পিপিআরের কোথাও এ সুযোগ আছে কি না। কিন্তু তারা আমাদের জবাব দিতে পারেননি। আমরা এনসিটিবিকে আরো বলেছি দরপত্রের শতভাগ শর্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আমরা পাঠ্যবই সরবরাহ করব, কিন্তু আমাদের কাজ শেষে সময়মতো টাকা দেয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারবেন কি না জানতে চেয়েছি। কিন্তু তারা এরও কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তাহলে আমরা কিসের আশায় বেআইনি শর্তযুক্ত এ চিঠি নেব।

তোফায়েল খান বলেন, আমরা শর্ত মেনে বই ছাপালাম। কিন্তু বই ছাপার পর বিশ্বব্যাংকের শর্ত মোতাবেক নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান যদি বলে বই ঠিকমতো হয়নি, তখন আমাদের কী উপায় হবে? আমাদের বিল তো তখন আটকে যাবে।

দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ দেয়ার ব্যাপারে দরপত্রের বাইরে বিশ্বব্যাংক নতুন করে যেসব শর্তারোপ করেছে তার মধ্যে রয়েছে- স্বাধীন একটি সংস্থা কর্তৃক বইয়ের মান সঠিক বলে প্রতিবেদন প্রদানসাপেক্ষে দেশীয় মুদ্রণ শিল্প মালিকদের বিল দিতে হবে। জামানত বিদ্যমান ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করতে হবে। বিশ্বব্যাংক টেকনিক্যাল অডিটের মাধ্যমে বইয়ের মান যাচাই করবে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক স্বাধীনভাবে বইয়ের মান যাচাইয়ের কাজ করবে। এ জন্য বিভিন্ন স্তরে তাদের নমুনা সরবরাহ করতে হবে প্রেস মালিকদের।

বিশ্বব্যাংকের শর্তযুক্ত চিঠি দেশীয় মুদ্রণ শিল্প মালিকদের পাঠানোর বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে কী বলা হয়েছে জানতে চাইলে এনসিটিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রণালয় থেকেও বিশ্বব্যাংকের শর্তযুক্ত চিঠিই পাঠাতে বলা হয়েছে তাদের।
প্রাথমিকের বই ছাপার ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাছাই হওয়া বাংলাদেশী মুদ্রণ শিল্প মালিকেরা আগেই এনসিটিবিকে জানিয়ে দিয়েছে দরপত্রের বাইরে নতুন করে আরোপিত কোনো শর্ত তারা মেনে নেবেন না এবং বই ছাপার কাজও করবেন না। বিশ্বব্যাংকের আরোপ করা শর্ত দিয়ে তাদের চিঠি দেয়া হলে তারা মাধ্যমিকেরও বই ছাপার কাজ বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেন এর আগে। তা সত্ত্বেও এনসিটিবির পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকের শর্ত জুড়ে দিয়েই চিঠি পাঠানো হচ্ছে সর্বনিম্ন দরদাতা বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে।
এর কারণ হিসেবে এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র পাল নয়া দিগন্তকে বলেন, বাংলাদেশী মুদ্রণ শিল্প মালিকদের নোটিফিকেশন অ্যাওয়ার্ড পাঠানোর চিঠি অনুমোদনের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠানো হয় এবং তারা তাদের শর্ত দিয়েই চিঠি দিতে বলেছে। এনসিটিবিকে মঙ্গলবার বিশ্বব্যাংক থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে মুদ্রণ শিল্প মালিকদের নোটিশ পাঠানোর বিষয়ে।

এবার প্রাথমিকের সাড়ে ১১ কোটি বই ছাপার জন্য ৯৮টি লটের সবগুলোতে সর্বনিম্ন দরদাতা হয় বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান। ভারতের কোনো প্রতিষ্ঠান এবার সর্বনিম্ন দরদাতা হয়নি। কিন্তু সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ পাওয়া নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয় এবং দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। কারণ এনসিটিবি প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিকের জন্য প্রচলিত বাজার দর অনুযায়ী ছাপার খরচ নির্ধারণ করে ৩৩০ কোটি টাকা। কিন্তু বাংলাদেশী দরদাতারা ১০৯ কোটি টাকা কমে মাত্র ২২১ কোটি টাকায় বই ছাপার কাজ করে দিতে রাজি হন। এতে প্রশ্ন তোলা হয় এত কম দামে তারা মানসম্মত বই ছাপতে পারবেন কি না? এ পরিপ্রেক্ষিতে বইয়ের মান নিশ্চিত করার জন্য দরপত্রের শর্তের বাইরে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বেশ কিছু নতুন শর্তারোপ করা হয় বাংলাদেশীয় প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার ক্ষেত্রে। আর এর তীব্র বিরোধিতা করে আসছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।
গত ২৯ এপ্রিল আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে এনসিটিবি। ভারত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ মিলিয়ে মোট ৭৫০টি দরপত্র জমা পড়ে। দরপত্র মূল্যায়নে সব লটে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রাথমিকে ২০টি ও প্রাক-প্রাথমিকে দু’টি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বাছাই করে এনসিটিবি। অনেক লটে ভারতের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে নির্বাচিত হয়।

যেহেতু বিশ্বব্যাংক বই ছাপার কাজে লোন দেয় (সাড়ে ৯ শতাংশ), তাই নিয়মানুযায়ী দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার জন্য বাছাই তালিকা করে সম্মতির জন্য তা পাঠানো হয় বিশ্বব্যাংকের কাছে গত ১৯ জুলাই। এরপর কম দাম নিয়ে বিতর্ক ওঠার পর চলতি আগস্ট মাসে বিশ্বব্যাংক ব্যাখ্যা চায় এনসিটিবির কাছে। সূত্র জানায়, সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বাছাই করা বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে আপত্তি তোলা হয় এবং আবার টেন্ডারের আহ্বান জানায় তারা।
তবে তাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রাজি না হওয়ায় বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার বিষয়ে সম্মতি জানিয়ে গত ১৮ আগস্ট দশটি নতুন শর্ত দিয়ে এনসিটিবিকে চিঠি দেয় বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিস।

দেশীয় মুদ্রন শিল্প মালিকরা অভিযোগ করেণ তাদেরকে কাজ না দিয়ে ভারতকে কাজ দেয়ার জন্যই বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে নতুন করে এ শর্ত আরোপ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে দেশি শিল্প মালিকরা বলেন, কিভাবে আমাদের নোটিফিকেশন অ্যাওয়ার্ড দেয়া হবে, আমাদের কাজ এনসিটিবি কিভাবে তদারিক করবে তার সবকিছুই দরপত্রে উল্লেখ আছে। তখন আমদের সামনে বিশ্বব্যাংক বলতে কিছু ছিলনা। আমরা কাজ নিয়েছি এনসিটিবির। কিন্তু এখন হঠাৎ করে শেষ পর্যায়ে বাইরে থেকে নতুন করে আরেকটি প্রতিষ্ঠান এসে আমাদের ওপর খবরদারি করবে এবং তাদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে না পারলে আমরা বিল পাবনা এমন শর্ত শুধু বে-আইনী নয় সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলক। দেশীয় প্রতিষ্ঠান যাতে কাজ না পায় সেজন্য পরিকল্পিতভাবেই বিশ্বব্যাংক এ শর্ত আরোপ করেছে অভিযোগ করেছেন মুদ্রনশিল্প সমিতির নেতৃবৃন্দসহ আরো কয়েকটি সূত্র।

উল্লেখ্য ২০১০ সাল থেকে গত পাঁচ বছরে ভারত মোট ১৪ কোটি প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ পায়। বঞ্চিত হয় দেশের শিল্প মালিক এবং গরিব শ্রমিকরা। তাই শুরু থেকেই প্রাথমিকের বই ছাপার জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্রের বিরোধীতা করে আসছে দেশীয় মুদ্রণ শিল্প মালিকরা।