তৃতীয়বারের মতো অনাস্থা ভোটে উতরে গেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা। পার্লামেন্টে তাঁর দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) সদস্যসংখ্যা বেশি হওয়ায় এবারও তিনি অনাস্থা প্রস্তাবে বেঁচে যান। সম্প্রতি তাঁর দুর্নীতিসংক্রান্ত একটি টেপ প্রকাশিত হওয়ার পর এই অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়। সাবেক দুর্নীতিবিরোধী কর্মকর্তা থুলি ম্যাডোনসেলার অভিযোগের পর জুমার সরে যাওয়ার দাবি এসেছে বিরোধী দলসহ সর্বস্তর থেকে। এর পরও তিনি অনাস্থা ভোটে উতরে যাচ্ছেন। কারণ এএনসির সদস্যরা জুমাকে সরিয়ে দিতে চাইছেন না। তাঁরা আশা করছেন, জুমা নিজ থেকেই প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে যাবেন। এ বছরের এপ্রিলে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমাকে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা ঘুষের অভিযোগ মোকাবিলা করতে হবে বলে আদেশ দিয়েছিলেন দেশটির হাইকোর্ট। এর আগে সরকারি কৌঁসুলিরা তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতিসংক্রান্ত ৭৮৩টি অভিযোগ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ আদেশ ওই কৌঁসুলিদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এক ধরনের চপেটাঘাত বলে ধরা হয়েছিল।
জুমাকে বিদায়ের আহ্বান
জ্যাকব জুমার সমালোচনা করে তাঁর দল এএনসিতে নেতৃত্ব পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছে নেলসন ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশন। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্ণবাদবিরোধী নেতা ম্যান্ডেলার স্মৃতি রক্ষার্থে গঠিত ফাউন্ডেশনটি এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘আমরা সরকারি দলকে অনুরোধ করছি রাষ্ট্রের দায়িত্ব একটি নিরাপদ হাতে দিতে।’
২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন সময় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে জ্যাকব জুমার বিরুদ্ধে। কিন্তু পার্লামেন্টে এএনসি সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় তিনি অভিশংসন থেকে রক্ষা পেয়েছেন। গত আগস্টে পৌর নির্বাচনে ভরাডুবির পর দল থেকেও জুমার সরে যাওয়ার দাবি উঠতে শুরু করে। ওই নির্বাচনে ১৯৯৪ সালের পর সবচেয়ে খারাপ ফল করে এএনসি।
‘স্টেট অব ক্যাপচার’
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জুমার বিরুদ্ধে এক দশকের বেশি সময় ধরে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। তবে তিনি বরাবরই অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছেন। জ্যাকব জুমার বিরুদ্ধে এক তদন্তে তাঁর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সম্ভাব্য দুর্নীতির আভাস মেলে।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থার সাবেক প্রধান থুলি ম্যাডোনসেলা এটি তৈরি করেছেন। তদন্ত প্রতিবেদনে একসময়ের সরকারি কৌঁসুলি থুলি ম্যাডোনসেলা ৩০ দিনের মধ্যে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করার জন্য প্রেসিডেন্ট জুমার কাছে সুপারিশ করেছেন। প্রেসিডেন্ট জুমার বিরুদ্ধে ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক রাখার অভিযোগ উঠেছে। তিনি এ প্রতিবেদন প্রকাশের বিষয়টি আদালতের আশ্রয় নিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন। ৩৫৫ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনটির শিরোনাম ‘স্টেট অব ক্যাপচার’। এর প্রচ্ছদে রয়েছে পুতুলনাচের কয়েকটি সুতা বাঁধা একটি হাতের চিত্র।
প্রবল প্রতিবাদের মুখে
প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষুব্ধ জনতা জ্যাকব জুমার পদত্যাগের দাবি নিয়ে রাস্তায় বিক্ষোভে নামে। কফিন নিয়ে জ্যাকবের মূর্তি পুড়িয়ে তারা প্রতিবাদ করে। অফিস ঘেরাও করে। পুলিশ বিক্ষুব্ধ জনতাকে প্রতিহত করার জন্য পানি, রাবার বুলেট ছোড়ে।
বিক্ষুব্ধ জনতা দাবি করছে, ক্ষমতায় থাকার আর কোনো অধিকার তাঁর নেই।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকেই জ্যাকব জুমা প্রচণ্ডভাবে সমালোচিত। দুর্নীতি, নারী কেলেঙ্কারি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ—হেন কোনো অপকর্ম নেই, তিনি করেননি। নেলসন ম্যান্ডেলার দল এএনসির সুনাম তিনি তলানিতে এনে ঠেকিয়েছেন।
জ্যাকব জুমার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, তিনি ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে ক্ষমতা খাটানোর সুযোগ করে দিয়েছেন। বিশেষ করে ভারতীয় ব্যবসায়ী গুপ্ত পরিবারকে। গুপ্ত পরিবারই প্রধানত জ্যাকব জুমার দুর্নীতির প্রধান হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়। কেউ কেউ এমনও প্রশ্ন করেছেন, দক্ষিণ অফ্রিকা রাষ্ট্রটি কি আসলে সরকার চালায়, নাকি গুপ্ত পরিবার?
কে এই গুপ্ত পরিবার
ভারতের উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুরের শিবকুমার গুপ্তের তিন ছেলে অতুল গুপ্ত, অজয় গুপ্ত এবং রাজেশ গুপ্ত। ১৯৯৩ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা ক্ষমতায় আসার পর দক্ষিণ অফ্রিকার বাজার ব্যবসায়ীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। তখন বাবা ছেলেদের আফ্রিকায় পাঠান। তিনি ছেলেদের এই বলে উৎসাহ দেন যে আফ্রিকায় গিয়ে ভাগ্য অন্বেষণ করো। আফ্রিকা একদিন আমেরিকা হবে।
১৯৯৩ সালে অতুল গুপ্ত দুই ভাই অজয় গুপ্ত ও রাজেশ গুপ্তকে নিয়ে দক্ষিণ অফ্রিকায় আসেন। প্রথমে তাঁরা কম্পিউটার যন্ত্রপাতির ব্যবসা শুরু করেন। নাম দেন সাহারা কম্পিউটার। পরবর্তী সময় ট্রান্সপোর্ট ও খনি ব্যবসা শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকায় বেশ প্রভাবশালী একটি ব্যবসায়িক পরিবার হিসেবে আবির্ভূত হন।
২০০৯ সালে জ্যাকব জুমা প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগ থেকেই এএনসি দলটির সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক। তবে সরকারি দলের সঙ্গে তাঁদের সুসম্পর্কের কথা জনগণ জানতে পারে ২০১৩ সালে গুপ্ত পরিবারের একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে জ্যাকব জুমার উপস্থিতির পর থেকে। সে বিয়ের অনুষ্ঠান দক্ষিণ অফ্রিকায় আলোড়ন সৃষ্টি করে। দেশের জনগণ একসময় জানতে পারে কাকে কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হবে, আড়াল থেকে তা নিয়ন্ত্রণ করে গুপ্ত পরিবার। সম্প্রতি সহকারী অর্থমন্ত্রী ম্যাকবিসি জুনাস জানিয়েছেন, তাঁকে ২০১৫ সালে মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিয়েছিলেন গুপ্ত পরিবারের একজন। জুমার ছেলে দুদুজেন জুমা গুপ্ত পরিবারের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন। তাই জনগণ গুপ্ত ও জুমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছেন জুপ্তস।
জন্ম ঠিকুজি
জ্যাকব জুমার জন্ম ১২ এপ্রিল ১৯৪২, দক্ষিণ আফ্রিকার কোয়াজুলু-নাতাল প্রদেশের নান্দলা এলাকায়। ১৯৬০-এর দশকে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের বর্ণবৈষম্যনীতির বিপক্ষে অবস্থান করেছিলেন। সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়ে তাঁকে বেশ কিছু সময় কাটাতে হয় রবেন দ্বীপপুঞ্জের কারাগারে।
বাবা ছিলেন একজন পুলিশ, যিনি জুমাকে তরুণ অবস্থায় রেখে মারা যান। মা ছিলেন গৃহকর্মী। তিনি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারেননি।
২০০৭ সালে এএনসির ৫২তম সম্মেলনে থাবো এমবেকিকে পরাভূত করে দলের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি।
২০০৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সংসদে তাঁর দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের জয়লাভের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। মাদিবার (ম্যান্ডেলার গোষ্ঠীগত নাম) ভাবমূর্তি কাজে লাগিয়ে ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ায় আরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত হয় প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমার।
কেলেঙ্কারি থাকলেও জনপ্রিয়
তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক জনসমর্থনের কারণেই তিনি অশিক্ষিত পশুপালক থেকে দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হয়েছেন। নেতৃত্বের সহজাত গুণ রয়েছে তাঁর মধ্যে। নানা কেলেঙ্কারি থাকলেও সমালোচনা যেন তাঁর গায়েই লাগে না। জনপ্রিয়তাও থাকে অটুট। বহুবিবাহে আসক্ত জুমার নারীঘটিত বিষয় প্রায়ই বিতর্কের তৈরি করে। বিরোধী দলসহ এএনসির কিছু নেতা অভিযোগ আনেন যে জুমার স্ত্রীদের ভরণপোষণে রাষ্ট্র ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। কেননা দেশটিতে দারিদ্র্য ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্ষমতার অপব্যবহার এবং রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে ব্যক্তিগত বাড়ির জৌলুস বৃদ্ধির অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
৭২ বছর বয়সী জ্যাকব জুমা এককালে স্বাধীনতাসংগ্রামে লড়েছেন। বর্ণবাদী শাসনের যুগে ১০ বছর কারাগারেও ছিলেন।
এএনসির মিত্র কনফেডারেশন অব সাউথ আফ্রিকান ট্রেড ইউনিয়নসের প্রধান এসদুমো দলামিনি মনে করেন, ‘একজন গৃহকর্মীর ছেলে জুমার রয়েছে দরিদ্র ও শ্রমিক শ্রেণির কাছে শক্তিশালী গ্রহণযোগ্যতা। তিনি জনগণের লোক এবং শ্রমিকদের মতোই বড় হয়েছেন।’
সূত্র: কালেরকণ্ঠ