দেশে উচ্চশিক্ষার মান সন্তোষজনক নয়-বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণা নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কার্যক্রমের এ চিত্র আরো হতাশাজনক। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় বাজেটে পর্যাপ্ত অর্থের বরাদ্দ নেই। গবেষণায় পিছিয়ে থাকার কারণে বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই দেশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। উচ্চশিক্ষার মান সন্তোষজনক নয়। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।

img_140228969214022896921003.png_10_newsnextbd

দেশে পাবলিক ও বেসরকারি মিলে বর্তমানে ১১৮টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। লন্ডনভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের করা তালিকায় এশিয়ার সেরা একশ’ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পায়নি বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। তালিকায় সর্বোচ্চ স্থানটি দখল করেছে জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার মান, গবেষণাসহ কিছু মানদণ্ডের বিচারে তৈরি এ বছর এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থানভিত্তিক এ তালিকা প্রকাশ করে।

ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে দেশের ৪৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ধরনের গবেষণা প্রকল্প পরিচালিত হয়নি। আর গবেষণা পরিচালনার লক্ষ্যে কোনো অর্থই বরাদ্দ দেয়নি ২০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এতে আরো বলা হয়, দেশের ৪৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী অধ্যাপক নেই। মাত্র একজন স্থায়ী অধ্যাপক আছেন এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৫। এর মধ্যে রয়েছে পাঁচটি পাবলিক ও ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিও রয়েছে এ তালিকায়। এছাড়া সহযোগী অধ্যাপক নেই ৪৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সহকারী অধ্যাপক নেই ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর বাইরে ১০ জনেরও কম স্থায়ী প্রভাষক নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়।

ইউজিসি বলছে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষকের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের অধিকাংশই রাজধানীতে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষাদান করেন। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চান না তারা। তাই প্রতিষ্ঠিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদানসাপেক্ষে অপেক্ষাকৃত কম প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেষণে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়েছে ইউজিসির প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে উচ্চশিক্ষা বিষয়ে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ তুলে ধরেছে ইউজিসি। এতে বলা হয়, উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো এ খাতে অর্থ বরাদ্দ কম থাকা। দেশে উচ্চশিক্ষা খাতে সরকারি বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের মাত্র ০ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এ বরাদ্দে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ন্যূনতম চাহিদা মেটানো সম্ভব হয় না। দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে বার্ষিক পদ্ধতি আবার কোনোটিতে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু রয়েছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে বছরে তিনটি সেমিস্টারও রয়েছে। সিলেবাসেও রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। এতে শিক্ষার্থীরা ক্রেডিট ট্রান্সফারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান বদলের সুযোগ পান না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটি সমন্বিত পদ্ধতি ও সিলেবাস থাকা প্রয়োজন বলে ইউজিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইউজিসির পক্ষ থেকে বেশকিছু সুপারিশ করা হয় ওই প্রতিবেদনে। এর মধ্যে শিক্ষকদের দক্ষ করে তুলতে দেশে-বিদেশে এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণের সুযোগ প্রদান, ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রশিক্ষণ একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা, মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি আকর্ষণীয় বেতন কাঠামো প্রবর্তন করা এবং যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ। এছাড়া উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারণ ও সুসংহতকরণের লক্ষ্যে ইউজিসিকে একটি স্বাধীন সংবিধিবদ্ধ ‘উচ্চশিক্ষা কমিশন’ হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

অন্যদিকে, দেশে বর্তমানে ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাজেটে প্রতি বছর বরাদ্দ বাড়লেও গবেষণা খাতে কোনো বরাদ্দ নেই। বরাদ্দকৃত অর্থের সিংহভাগ ব্যয় করা হয় শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও পেনশনের পেছনে। এছাড়া বই-পুস্তক, জার্নাল কেনা, কেমিক্যাল ও ইক্যুইপমেন্ট, শিক্ষা সফর, ছাত্রদের পরিবহন খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্য ৪২৫ কোটি ৫০ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার পেছনে বরাদ্দকৃত অর্থের ২৫০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা (৫৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ) ব্যয় হবে।

এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ৩০ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় লেখাপড়া করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এশিয়াতে শিক্ষার্থী সংখ্যায় আমাদের অবস্থান চতুর্থ। তিনি বলেন, শিক্ষার চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, গবেষণায় বরাদ্দ ও অবকাঠামো উন্নয়ন না হওয়ায় উচ্চশিক্ষার কাক্সিক্ষত মান ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।