ঢাকা বোর্ডে আবারও নিয়োগ বাণিজ্য!

গত বছর মাস্টার রোলে ১০ কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে; কিন্তু ওই নিয়োগ বাতিলের আদেশ জারি করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। কারণ জোরালো প্রমাণ ছিল, ইউনিয়নের নেতারা নিয়োগে স্বজনপ্রীতি করেছেন; তবে হাল ছাড়েননি নেতারা। বোর্ডে আবারও প্রায় অর্ধশত জনবল নিয়োগ হবে। ইউনিয়নের নেতারা এখানে বাণিজ্যের পাঁয়তারা করছেন। তাদের ইঙ্গিতে চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য ‘সোনালী সেবা’র কোড নম্বর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশ করা হয়নি। ফলে আশানুরূপ আবেদন জমা পড়েনি।

কেবল নিয়োগবাণিজ্য নয়, নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনুমোদন, পরিদর্শন, নবায়ন, পরিচালনা কমিটি অনুমোদন, পরীক্ষার কেন্দ্র নির্ধারণ থেকে শুরু করে ঢাকা বোর্ডের অধিকাংশ কার্যক্রমই এখন ইউনিয়নের নেতাদের নিয়ন্ত্রণে। সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ ইউনিয়নের শীর্ষ দুই নেতা সভাপতি হুমায়ুন কবির ও সাধারণ সম্পাদক লোকমান মুন্সীর বিরুদ্ধে। এমনকি বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু বক্কর ছিদ্দিকও সমকালের সঙ্গে আলাপকালে স্বীকার করলেন, তার আমলে বোর্ডে দাপট বেড়েছে কর্মচারী ইউনিয়নের। তিনি চেষ্টা করছেন সামাল দিতে।

তবে ইউনিয়নের শীর্ষ দুই নেতা সমকালকে জানান, এ সবই অপপ্রচার। তারা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের ন্যায় বললেন, কোনো প্রভাব খাটান না। নিয়োগ নিয়ে টাকা-পয়সা লেনদেন হতে পারে, তবে এর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অসম্পূর্ণ!: ঢাকা বোর্ডের অফিস সহকারী, ড্রাইভার, দারোয়ান, এমএলএসএস, আর্ম গার্ড, মালীসহ মোট ৪৯টি পদে জনবল নিয়োগের জন্য গত ১৩ জানুয়ারি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এর পরই অর্থের বিনিময়ে নিজস্ব লোকজনকে নিয়োগের পাঁয়তারা শুরু করেন কর্মচারী ইউনিয়নের একশ্রেণীর নেতা। ২৮ জানুয়ারি ছিল আবেদন জমা দেওয়ার শেষ দিন। কিন্তু বোর্ড কর্তৃপক্ষের কৌশল আর ইউনিয়নের নেতাদের প্রভাবে শত শত চাকরিপ্রার্থী আবেদন করতে পারেননি। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে সোনালী ব্যাংকের ‘সোনালী সেবা’র মাধ্যমে আবেদন করতে বলা হলেও সোনালী সেবার কোড নম্বর ওই বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া হয়নি। আবেদনপত্র জমার সময় পার হওয়ার দু’দিন আগে ২৬ জানুয়ারি তা বোর্ডের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়। স্বভাবতই সাধারণ প্রার্থীরা আর এই কোড জানতে পারেননি।

অভিযোগ রয়েছে, কর্মচারী ইউনিয়নের নেতাদের পছন্দের প্রার্থীদের চাকরি দিতেই বোর্ড কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে ‘সোনালী সেবা’র কোড নম্বর বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশ করেনি। আবার জেলা কোটার বাধ্যবাধকতাও তুলে দেওয়া হয় বিজ্ঞপ্তিতে। কারণ, জেলা কোটা কার্যকর করলে কর্মচারী ইউনিয়নের শীর্ষ দুই নেতার নিজ জেলা মানিকগঞ্জ ও শরীয়তপুর থেকে কাউকে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ ছিল না। বিভিন্ন পদে প্রধানত এ দুটি জেলার লোকজনের সঙ্গেই ‘রফা’ হচ্ছে কর্মচারী নেতাদের। তবে আশানুরূপ আবেদন জমা না পড়লেও নিয়োগ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। বোর্ডের সচিব শাহেদুল কবির চৌধুরী সমকালকে বললেন, ‘আবেদনপত্রগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। স্বচ্ছতার সঙ্গেই নিয়োগ কার্যক্রম শেষ করা হবে।’

ইউনিয়নের দাপট: বোর্ড প্রশাসনকে কব্জায় নিয়ে নানা অনিয়ম করে চলেছেন ইউনিয়নের দুই শীর্ষ নেতা। তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় বোর্ড প্রশাসনকে ব্যবহার করে ১৪ জানুয়ারি ছয়জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। চাকরিচ্যুতরা হলেন- লাইব্রেরি সহকারী বাবুল আকন্দ, তিন উচ্চমান সহকারী জালালউদ্দিন, মো. আনোয়ার হোসেন ও মঈন উদ্দিন, জুনিয়র অডিটর আজিজুর রহমান ও মেশিন অপারেটর মিজানুর রহমান অনু।

বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক পাঠদান অনুমতি এবং একাডেমিক স্বীকৃতি দিতেও মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন নেতারা। ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লোকমান মুন্সী তার গ্রামের বাড়ি এলাকার এক শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তার নাম ভাঙিয়ে বোর্ডের কর্মচারীদের সন্ত্রস্ত করে রেখেছেন। যখন-তখন বোর্ডে পুলিশ এনে মোতায়েন করেন, প্রভাব খাটান তিনি। শরীয়তপুরে ওই পুলিশ কর্মকর্তার বাবা ও মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত ‘জোহরা-কাদীর স্কুল অ্যান্ড কলেজ’-এর অনুমোদন নিতেও সহায়তা করেন এ নেতা। নতুন স্কুল-কলেজের অনুমোদনের ক্ষেত্রে প্রভাব খাটান নেতারা। নিজস্ব জমি নেই, পর্যাপ্ত শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী নেই, কাগজপত্র ভুয়া, এমন প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনেও তারা প্রভাব খাটান। এসব কারণে নতুন স্কুল-কলেজের অনুমোদন দেওয়া বর্তমানে প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ইউনিয়নের সভাপতি হুমায়ুন কবীর সম্প্রতি তার নিজের জেলা মানিকগঞ্জে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে একটি পরীক্ষা কেন্দ্রের অনুমতি নেন। ধরা পড়ার পর তা বাতিল করেছে বোর্ড কর্তৃপক্ষ।

নিয়োগবাণিজ্য: কর্মচারী ইউনিয়নের নেতারাই নিয়ন্ত্রণ করেন বোর্ডের সব নিয়োগ। এর আগেও বিভিন্ন পদে প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের আত্মীয়স্বজনকে নিয়োগ দিয়েছেন তারা। গত বছরের জুনে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি হুমায়ুন কবির ও সাধারণ সম্পাদক লোকমান মুন্সীর চাপে বোর্ড চেয়ারম্যান মো. আবু বক্কর ছিদ্দিক গণমাধ্যমে কোনো বিজ্ঞপ্তি না দিয়েই অস্থায়ী ভিত্তিতে ১০ কর্মচারী নিয়োগ দেন। এ নিয়োগে অবৈধভাবে প্রায় অর্ধকোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ করা এই ১০ কর্মচারীর মধ্যে তিনজনই ছিলেন কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লোকমান মুন্সীর আপন ভাই। আর ইউনিয়ন সভাপতি হুমায়ুন কবীরের নিকটাত্মীয় তিনজন। কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. লোকমান মুন্সীর নিয়োগ পাওয়া আপন ভাই হলেন- মো. জুলহাস মুন্সী (অফিস আদেশ নম্বর ৩০৬), মো. ফজলুল হক মুন্সী (অফিস আদেশ নম্বর ৩০৭) ও মো. জসিম মুন্সী (অফিস আদেশ নম্বর ৩০৮)। সভাপতি মো. হুমায়ুন কবিরের তিন আত্মীয় হলেন- মো. নজরুল ইসলাম (অফিস আদেশ নম্বর ৩০২), মো. আশফাকুর রহমান (অফিস আদেশ নম্বর ৩০৩) ও শরীফুল ইসলাম (অফিস আদেশ নম্বর ৩০৪)। নিয়োগপ্রাপ্ত অন্যরা হলেন- মো. আসিফ আহমেদ (অফিস আদেশ নম্বর ৩১০), মো. ওবায়েদুল হক পলাশ (অফিস আদেশ নম্বর ৩০৯), মো. শাকিল আহম্মেদ (অফিস আদেশ নম্বর ৩০৫) ও মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন (অফিস আদেশ নম্বর ৩১১)। বোর্ডের ১৫১ কর্মচারী অভিযোগপত্র দিয়ে অনিয়মের বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আনলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ওই নিয়োগ বাতিল করে।

নতুন লোকবল নিয়োগের বিরোধিতা করে কর্মচারীদের এ অভিযোগপত্রে বলা হয়, শিক্ষা বোর্ডে পর্যাপ্ত লোকবল রয়েছে। নতুন করে লোক নিয়োগ দেওয়া হলে ভবিষ্যতে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে কর্মচারীদের অবসরে পাঠাতে হবে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ড গঠিত হলে ঢাকা বোর্ডের ৪০ শতাংশ কাজ কমে যাবে। এদিকে কর্মচারী ইউনিয়নের শীর্ষ নেতাদের পছন্দের কর্মচারীরা ছয় থেকে আট বছর ধরে স্কুল-কলেজ পরিদর্শন শাখাসহ গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলোতে কাজ করছেন। এর আগে কোনো শাখায় কেউ তিন বছরের বেশি থাকতে পারেননি। ইউনিয়ন নেতারা এসব কর্মচারীর মাধ্যমে অন্যায়ভাবে আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন বলেও অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে।

এসব অভিযোগ অস্বীকার করে কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি হুমায়ুন কবীর সমকালকে বলেন, ‘যারা এসব কথা বলেন, তারা বিএনপি-জামায়াত। তিনি কোনো ভুয়া কেন্দ্রের অনুমোদন নেননি। যাদের চাকরি চলে গেছে, তাদের মধ্যে তার দুই ভাগিনাও রয়েছে। তাহলে প্রভাব খাটালেন কোথায়? নিয়োগ কমিটি নিয়োগ দিচ্ছে। এ নিয়ে কেউ টাকা-পয়সা লেনদেন করছে বলে তার জানা নেই।’ সাধারণ সম্পাদক লোকমান মুুন্সী বলেন, যারা এসব বলে তারা মিথ্যা কথা বলে। আপন তিন ভাইয়ের নিয়োগের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘এটা ছিল অস্থায়ী নিয়োগ।’

বোর্ডে ইউনিয়নের দাপট বেড়েছে স্বীকার করে চেয়ারম্যান আবু বক্কর ছিদ্দিক সমকালকে বলেন, ‘এপ্রিলের ২০ তারিখে আমার চাকরি শেষ। প্রয়োজনে নিয়োগ না দিয়েই চলে যাব, তবু দুর্নীতি হতে দেব না। শেষ জীবনে নিয়োগ নিয়ে দুর্নাম কামাব না।’ তিনি বলেন, ‘ইউনিয়ন নেতারা সবখানেই প্রভাবশালী। নিয়োগ-পদোন্নতিতে নেতাদের কথা শুনতে হয়। নিয়োগের দায়িত্ব যাকে দেওয়া হয়েছিল, তার ব্যর্থতার কারণেই এ সমস্যা দেখা দিয়েছে।’

সূত্র: সমকাল