জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ লাখ শিক্ষার্থীর জীবন সেশন জটের খপ্পড় থেকে ক্রাশ প্রোগ্রামের জাঁতাকলে পড়ে ধবংসের উপক্রম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের স্বৈতন্ত্রের বলি উপ-উপচার্য, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক থেকে শুরু করে ২১ লাখ শিক্ষার্থীর প্রায় সবাই। ইচ্ছেমত খরচ করছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ফান্ডে থাকা কয়েকশ কোটি টাকা। অনুগত সংবাদকর্মীদের দিয়ে পক্ষে সংবাদ লেখানোর চেষ্টাও খানিকটা সফল হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যের পদ থেকে বিতারিত হয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে আসীন হওয়া অধ্যাপক হারুন অর রশীদ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশও মানছেন না উপাচার্য। তার বিরুদ্ধে রয়েছে শিবিরপন্থী সাংবাদিকদের লালন-পালনের অভিযোগ। ভয়ে মুখ খুলছেন না উপ-উপাচার্য থেকে শুরু করে সেকশন অফিসার পর্যন্ত কেউই। পুরো ঘটনাকে ‘হারুন স্যারের স্বৈরতন্ত্র’ আ্খ্যা দিয়ে প্রকৃত সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করার আহবান জানিয়েছেন গোপণে।
ভুক্তভোগীদের মতে, কোর্স শেষ না করেই শিক্ষার্থীদের বসতে হচ্ছে চূড়ান্ত পরীক্ষায়। সেশনজট কমাতে ক্লাসের চেয়ে পরীক্ষা নিতেই তৎপরতা বেশি। উচ্চশিক্ষার মতো বড় জায়গায় শিক্ষার্থীরা কী শিখল আর না শিখল তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই তাদের। ফলে অসহায় হয়ে পড়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষাবিদরা বলেন, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বিভিন্ন সময়ে ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়ে থাকে। কিন্তু সেসব প্রতিষ্ঠানের কম সময়ে বেশি পড়ানোর দক্ষতা থাকতে হয়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরও সেভাবে তৈরি করা হয়। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো আগের নিয়মেই চলছে। যথেষ্ট পরিমাণে শিক্ষক সংকট রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কোনো কিছুর উন্নয়ন না ঘটিয়ে শুধু কোর্সের সময় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
২০০৯ খ্রিস্টাব্দেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারি কলেজগুলো আলাদা করার সুপারিশ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকসহ কয়েকজন শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী। আরেফিন সিদ্দিক দৈনিকশিক্ষাডটমকে বলেন, ‘খুবই ক্ষতি করে ফেলছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সময়ের আগে পরীক্ষা নিয়ে তারা সেশনজট কমাতে চাচ্ছে। কিন্তু না পড়ালে কী পরীক্ষা দেবে শিক্ষার্থীরা। প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের আগস্টে সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। উচ্চশিক্ষাকে রক্ষা করতে হলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারি কলেজগুলোকে আলাদা করার কোনো বিকল্প নেই।’
সেশনজট নিরসনে ক্রাশ প্রোগ্রামের অধীনে ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে ক্লাস শুরু থেকে পরীক্ষা পর্যন্ত ৯ মাস করে শিক্ষাবর্ষ ধরা হয়েছে। পরীক্ষা বাদ দিলে ক্লাসের সময় পাওয়া যাবে সাত মাস। অথচ জাতীয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে অসংখ্য কোর্স থাকায় প্রায় সব সময়ই পরীক্ষা চলে। সেই সময়েও কলেজগুলোতে ঠিকমতো ক্লাস হয় না। সরকারি ছুটির বাইরেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের ছুটি থাকে। ফলে খুব কম সময়ই ক্লাসের সুযোগ পায় শিক্ষার্থীরা।
ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ হোসনে আরা বলেন, ‘১২ মাসের পড়া আট মাসে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর যদি আট মাসেই শেষ করতে হয়, তাহলে সিলেবাস চেঞ্জ করতে হবে। এখন আমরা মূলত শিক্ষার্থীদের ফাঁকি দিচ্ছি। তারাও ঠিকমতো শিখতে পারছে না। সায়েন্সের অবস্থা তো সবচেয়ে খারাপ। বিষয়টি আমরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেও জানিয়েছি। কিন্তু এখনো কোনো ফল পাইনি।’
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্রাশ প্রোগ্রাম ঘোষণা করলেও ইতিমধ্যেই তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। শিডিউল অনুযায়ীও পরীক্ষা নিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। কিন্তু পরীক্ষার সূচি ঘোষণার পরই ক্লাস বন্ধ থাকছে। ফলে পরীক্ষাও হচ্ছে না আবার ক্লাসও হচ্ছে না। এ কারণে পাঠের বাইরে থেকে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের প্রথম বর্ষ স্নাতক (পাস) শিক্ষার্থীদের ক্রাশ প্রোগ্রামের আওতায় পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল ২০১৫ সালের মে মাসে। এরপর দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ২০১৫ সালের জুন মাসে এবং পরীক্ষা হওয়ার কথা ২০১৬ সালের মার্চ মাসে। এরপর তৃতীয় বর্ষ বা চূড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে। কিন্তু প্রথম বর্ষের পরীক্ষা নির্ধারিত তারিখে নিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। তা শুরু হয়েছিল গত বছরের ১৯ নভেম্বর। এখন যদি ক্রাশ প্রোগ্রাম অনুযায়ী দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা নেওয়া হয়, তাহলে শিক্ষার্থীদের এক বছরের পড়া শেষ করতে হবে মাত্র চার মাসে।
জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম মানেই ক্রাশ হওয়া। এখানে সময় ক্রাশ হবে, এটা স্বাভাবিক। এটাকে জরুরি অবস্থাও বলা যায়। একটি শিক্ষাবর্ষ থেকে যদি দুই মাস সময় না কমাই, তাহলে সেশনজট থেকে উত্তরণ ঘটাব কিভাবে? আমাদের হাতে অত সময় নেই। আসলে একটা অর্জন করতে হলে আরেকটা ত্যাগ করতে হবে।’
হারুন-অর-রশীদ বলেন, ‘২০১৪ সালের পরীক্ষাও ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। ক্রাশ প্রোগ্রাম না হলে এটা সম্ভব হতো না। তবে আমরা যে একাডেমিক ক্যালেন্ডার ঘোষণা করেছি সেখান থেকে এক-দুই সপ্তাহ আগে-পিছে হতে পারে। এটা ধরে নিয়েই আমরা ক্যালেন্ডার সাজিয়েছি। আমরা যেভাবে এগোচ্ছি তাতে ২০১৮ সালের জুন মাসের মধ্যে সেশনজটমুক্ত হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।’
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) তাদের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজ থেকে পাস করা স্নাতকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। কলেজগুলোতে শিক্ষক সংকট, শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকা, গবেষণার অভাব, নিয়মিত ক্লাস না হওয়াসহ নানা সমস্যা রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত স্নাতকোত্তর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করে সেখানে কেবল মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে সুপারিশ করেছে ইউজিসি।
ঢাকা কলেজ থেকে অ্যাকাউন্টিং নিয়ে পড়া অনার্স তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার্থী হোসেন আলী বলেন, ‘সেশনজট থেকে বাঁচানোর নামে আমাদের ওপর পরীক্ষার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ৯ মাস সময়ের কত মাস ক্লাস হয়েছে? প্রাইভেট পড়ে কোর্স শেষ করলেও পুরোপুরি প্রস্তুতি নেওয়া প্রায় অসম্ভব। সেশন এক মাস কমালেও একটি কথা ছিল। একবারে তিন মাস কমালে সিলেবাসও ওইভাবে তৈরি করা উচিত ছিল। আমরা সেশনজটও চাই না, আবার পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়েই পরীক্ষা দিতে চাই।’
জানা যায়, ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি কলেজগুলোকে সংশ্লিষ্ট এলাকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন প্রায় দুই হাজার ১৫০টি কলেজে ২১ লাখ শিক্ষার্থী থাকলেও সরকারি ১৮৪টি কলেজেই অধ্যয়ন করে ১৩ লাখ শিক্ষার্থী। আর এই ২১ লাখ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন, ফরম পূরণসহ নানা খাতে টাকা আদায় করে তারা। এতে তাদের আয়ও হয় অনেক।
নানাভাবে খরচ করেও কয়েক শ কোটি টাকা এখনো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে রয়েছে। কিন্তু সরকারি কলেজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে হাতছাড়া হলে আয়ের বড় উৎসই থাকবে না। তাই যেকোনো উপায়ে তারা সরকারি কলেজকেও তাদের সঙ্গে রাখতে চায়। এ জন্য ২০১৮ সালের মধ্যে সেশনজট নিরসনে অদ্ভুত ক্রাশ প্রোগ্রাম ঘোষণা করা হয়েছে। সেই প্রোগ্রামে অধিভুক্ত কলেজগুলোকে কোনো প্রকার সহায়তা না করে এক বছরের কোর্স ৯ মাসে নামিয়ে আনা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারি কলেজগুলোকে আলাদা করতে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে বৈঠক করে ইউজিসি। সেই বৈঠকে এ বিষয়ে কাজ করতে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটিও সরকারি কলেজগুলোকে পৃথক করার পক্ষে মত দিয়েছে। তারা ২১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৮৪টি কলেজকে ভাগ করে দিতে সুপারিশ করেছে।
সূত্র: দৈনিক শিক্ষা