মানিকগঞ্জের দক্ষিণ সেওতা গ্রামের হালিম চৌধুরী সড়কের মির আরিফুর রহমান খাদ্য পরিদর্শক পদে নিয়োগ পান। তিনি লিখিত পরীক্ষায় পেয়েছিলেন ৮ নম্বর। সেই ৮ হয়ে যায় ৮৯। নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুকুর গ্রামের মোসা. জেসমিন আক্তার পেয়েছিলেন ১৯। ফলাফল শিটে তাঁর নম্বর দেখানো হয় ৯১। ঢাকার ৮৮ শুক্রাবাদের অপূর্ব কুমার রায় পেয়েছিলেন ২৫। সেটা হয়ে গেছে ৯০। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার দয়াকান্দা গ্রামের আসমা ইসলামের ২৬-কে দেখানো হয় ৮৯। একই জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার মুরাপাড়া গ্রামের জাহানারা জলির ৪১ হয়ে যায় ৯০। টাঙ্গাইলের ধনবাড়ির মুশদ্দি খন্দকারপাড়া গ্রামের শামছুন নাহারের ৩৭ হয়ে যায় ৯১। ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার মধুখালী বাজার গ্রামের হালিমা আহমেদ ৩৪ পেয়েছিলেন। সেটা পরিবর্তন করে ৮৮ করা হয়। এভাবে ৪৪ জন প্রার্থীর ফলাফল শিটের নম্বর বদলে ফেলে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়।
শুধু লিখিত পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়ে অনেককে চাকরিতে ঢোকানো যায়নি। তাঁদের মৌখিক পরীক্ষার নম্বরও বাড়াতে হয়েছে। গাজীপুর জেলার সদর উপজেলার ৫১৫/১ দক্ষিণ চতর ছোটবাড়ির কোহিনুর আক্তারের ক্ষেত্রেই এ ঘটনা ঘটেছে। লিখিতর পাশাপাশি তাঁর মৌখিক পরীক্ষার নম্বরও বাড়াতে হয়েছে। তিনি লিখিত পরীক্ষায় পেয়েছিলেন ৫১। সেটা বাড়িয়ে ৯০ করা হয়। এর পরও তিনি প্রতিযোগিতায় টেকেননি। প্রকৃত মেধাবীদের চেয়ে তিনি তখনো ঢের পেছনে। কারণ তিনি মৌখিক পরীক্ষায় পেয়েছেন ১২। চাকরিতে প্রবেশ করাতে তাঁর আরো ১৬ নম্বর বাড়ানো হয়। মৌখিক পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল শিটে তাঁর নম্বর দেখানো হয়েছে ২৮। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামের আনিসুর রহমান মৌখিক পরীক্ষায় পেয়েছিলেন ১২। চূড়ান্ত ফলাফল শিটে তা দেখানো হয়েছে ২২। বগুড়ার শাহজাহানপুর উপজেলার পোয়ালগাছা
গ্রামের মুছা সরকারের মৌখিক পরীক্ষার নম্বরও বাড়ানো হয়েছিল।
এই লিখিত পরীক্ষার খাতা দেখা হয় কম্পিউটারের অত্যাধুনিক অপটিক্যাল মার্ক রিকগনিশন (ওএমআর) পদ্ধতিতে। কম্পিউটারের সফটওয়্যার বদলে দিয়ে কম নম্বর প্রাপ্তদের বেশি নম্বর দেখানো হয়েছে। খাদ্য অধিদপ্তরকে প্রযুক্তিগত সেবা দিয়েছিল বেসরকারি সংস্থা ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানার্স অ্যান্ড কনসালট্যান্টস (ডিপিসি)। সংস্থাটির সঙ্গে সরকারের চুক্তি হয়েছিল।
দুর্নীতি করে অযোগ্যদের যোগ্য দেখিয়ে চাকরি দেওয়ার জন্য শুধু ওএমআর শিটই পরিবর্তন করা হয়নি। চক্রটি বিধিও বদলেছিল। একপর্যায়ে দেখা যায় লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়েও কাজ হচ্ছে না। তখন চক্রটি বিধি পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়ম অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেণির চাকরির মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ছিল ২০। বিধি বদলে তা ৩০ করা হয়। মৌখিক পরীক্ষার মোট নম্বর বেশি হলে অনিয়ম করার সুযোগ বেড়ে যায়। যদিও একপর্যায়ে এসে আদালত মৌখিক পরীক্ষার নম্বর বাড়ানো অবৈধ ঘোষণা করেন এবং এই নম্বর ২০ ধরেই চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করার জন্য খাদ্য অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেন। এর পরই একে একে থলের বিড়াল বের হয়ে আসতে থাকে।
উল্লেখ্য, বিসিএসেও মৌখিক পরীক্ষার নম্বর বাড়ানো হয়েছে দুর্নীতির দুয়ার খোলার জন্যই। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিসিএসে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ছিল ১০০। কিন্তু ২০০৯ সালে সেই নম্বর ২০০ করা হয়। কারণ ১০০-তে সর্বোচ্চ নম্বর দিলেও পছন্দের প্রার্থীদের চাকরি দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না।
দুর্নীতি দমন কমিশন এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকার দায়ে ৫৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে। তবে তদন্ত শেষে আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অভিযোগপত্রটি গত ৭ মার্চ দুর্নীতি দমন কমিশন অনুমোদন করেছে। দুদক সচিব মোস্তফা কামাল গত বৃহস্পতিবার রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খাদ্য অধিদপ্তরের নিয়োগসংক্রান্ত বিষয়ে কাউকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে কি না, তা আমার জানা নেই। এ ব্যাপারে কমিশন ভালো বলতে পারবে।’ এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, সচিব নাও জানতে পারেন। অভিযোগপত্রটি অনুমোদন করেছে কমিশন। সেটা কমিশন থেকে সচিবের কাছে পাঠানো হবে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। এরপর সেটি যাবে আদালতে।
খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফয়েজ আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের চার্জশিট এখনো খাদ্য অধিদপ্তরে পৌঁছায়নি। অধিদপ্তরে এলে বিধিগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কমিশন যাঁদের অভিযুক্ত করেছে তাঁরা হচ্ছেন খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ইলাহী দাদ খান, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নাসিমা বেগম, খাদ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক ইফতেখার আহমদ, ডিপিসির পরিচালক মাহমুদুর রহমান, ডিপিসির ম্যানেজার (প্রশাসন) মো. আইউব আলী, ডিপিসির সিস্টেম অ্যানালিস্ট আসাদুর রহমান, হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার মো. আরিফ হোসেন এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাটাবেইস অ্যাডমিন মো. আবুল কাশেম। তাঁদের মধ্যে নাসিমা বেগম এখন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। তিনি খাদ্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় নির্বাচন/বাছাই কমিটির সদস্য ছিলেন। ইফতেখার আহমদ বর্তমানে উপসচিব পদে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনি খাদ্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় নির্বাচন/বাছাই কমিটির সদস্যসচিব ছিলেন। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ যাঁদের নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শেষ পর্যন্ত চার্জশিট থেকে তাঁদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। এর যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, তাঁদের নিজস্ব অর্থসম্পদ নেই। মা-বাবা বা অভিভাবক যদি সন্তানদের অজ্ঞাতে তাঁদের চাকরির জন্য কাউকে অর্থ দিয়ে থাকেন এর জন্য চাকরিপ্রার্থীদের দায়ী করা যায় না।
খাদ্য পরিদর্শক, উপখাদ্য পরিদর্শক, সহকারী উপখাদ্য পরিদর্শক, সুপারভাইজার, অডিটর, উচ্চমান সহকারী, হিসাবরক্ষক কাম ক্যাশিয়ার, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর, সহকারী অপারেটরের এক হাজার ৫৫২টি শূন্য পদ পূরণের জন্য খাদ্য অধিদপ্তর ২০১০ সালে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করে। আবেদনপত্র তালিকাভুক্ত করাসহ ফল প্রকাশ পর্যন্ত যাবতীয় কাজ করার জন্য আইটি সার্ভিস প্রভাইডার প্রতিষ্ঠান ডিপিসির সঙ্গে চুক্তি করে সরকার। আইটি প্রতিষ্ঠান লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে সহায়তা করে। এ পর্যায়ে তারা ৪৪ জনের প্রাপ্ত নম্বর সঠিকভাবে কম্পিউটারে ইনপুট না দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে ফলাফল শিট প্রকাশ করে। এ কাজে প্রতিষ্ঠানটি সফটওয়্যারে পরিবর্তন আনে। তাদের দেওয়া ফলাফল শিট অনুমোদন করে খাদ্য বিভাগের নিয়োগ কমিটি। এ কমিটি চাকরিপ্রার্থীদের স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেসরকারি আইটি প্রভাইডার প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে মেধাবীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা খাদ্য পরিদর্শক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ৩২৮ জন প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষার ওএমআর শিটের সঙ্গে প্রশ্নপত্রের সঠিক উত্তর শিট মিলিয়ে দেখি। এতে দেখা গেছে, ওএমআর শিটে কম আর ফলাফল শিটে বেশি নম্বর আছে। এ ধরনের প্রতারণা করে ৪৪ জনকে চাকরি দেওয়া হয়েছে।’
খাদ্য অধিদপ্তরের একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। এই নিয়োগ নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল। বিভাগীয় কমিশনার পর্যায়ের একজন কর্মকর্তাকে চাপে ফেলে দুর্নীতি করতে বাধ্য করা হয়েছে। নিয়োগ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হওয়ার পরও তা আটকানো যায়নি। এই নিয়োগ প্রক্রিয়া যাঁরা বাস্তবায়ন করেছেন, তাঁরা চার্জশিটে অভিযুক্ত হয়েছেন। কিন্তু নির্দেশদাতাদের নাম আসেনি। ওই সময়ের খাদ্যমন্ত্রী ও খাদ্যসচিব ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। একইভাবে সব কিছুর ঊর্ধ্বে রয়েছেন খাদ্য অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক। আর দুর্নীতি দমন কমিশন শুধু ৪৪ জনকে চিহ্নিত করতে পেরেছে, যাঁদের নম্বর বাড়িয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের বাইরেও আরো অনেকের নম্বরপত্র বদলে ফেলা হয়েছে। এসব অনিয়ম দুর্নীতি দমন কমিশনের অগোচরেই রয়ে গেছে।
সূত্র: কালের কণ্ঠ