“আল্লাহর কসম স্যার, আমি আপনার নামে কিচ্ছু বলিনি। আমাকে আর মারবেন না। অনেক ব্যথা লাগতেছে।” ছাত্রের এমন আকুতিতেও মন গলেনি উদয়ন স্কুলের শিক্ষক জাওশেদ আলমের। উল্টো আরও বেশি ক্রোধান্বিত হয়ে অষ্টম শ্রেণির কাকতাড়ুয়া শাখার ছাত্র জামিউল ইসলাম নাদিমকে কিল-ঘুষি-লাথি মারেন। এ দৃশ্য দেখে অষ্টম শ্রেণির অনেক শিক্ষার্থী ভয়ে কান্না শুরু করলেও তাতে শিক্ষক জাওশেদের মনে কোনো মায়া জাগেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অবস্থিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরে এভাবে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় উদ্বিগ্ন অভিভাববকরা। তারা আজ সোমবার বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েও ব্যর্থ হন।
এর আগেও এই বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক ছাত্রীর স্কুলড্রেসের হাতা কেটে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। ওই সময় স্কুলের অধ্যক্ষের পদত্যাগ ও সহকারী প্রধান শিক্ষিকার চুক্তিভিত্তিক বর্ধিত মেয়াদ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করেও কোনো ফল মেলেনি।
সম্প্রতি ছাত্র নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না তা নিয়ে সংশয়ে আছেন অভিভাবকরা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধে আইন করা হলেও তার কোনো তোয়াক্কাই করছেন না উদয়ন স্কুল কর্তৃপক্ষ।
নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীর স্বজনরা জানান, জামিউল ইসলাম নাদিম ১০ বছর ধরে উদয়ন স্কুলে পড়ছে। ঘটনার দিন ১৩ এপ্রিল সে অঙ্কের শিক্ষক জাকির হোসেনের ক্লাস করছিল। এ সময় শিক্ষক জাওশেদ আলম তাকে ক্লাস থেকে ডেকে নিয়ে মারধর করেন।
জানা গেছে, ঘটনার দিন দুপুরে অষ্টম শ্রেণীর চতুর্থ পিরিয়ডে গণিতের শিক্ষক জাকির হোসেনের ক্লাস করছিল শিক্ষার্থীরা। এ সময় জাওশেদ আলম এসে নাদিমকে খুঁজতে থাকেন। নাদিম তখন গণিত শিক্ষক জাকিরের অনুমতি নিয়ে ক্লাসের বাইরে গেলে জাওশেদ আলম তাকে ঝাঁঝালো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, “তুই আমার নামে কী বলেছিস?” নাদিম উত্তর দেয়, “স্যার, কিচ্ছু বলিনি তো।”
এ কথা শুনে ওই শিক্ষক নাদিমের ডান কানে সজোরে কয়েকটি আঘাত করেন। এরপর নাদিম ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলে তিনি তার চুলের মুঠি ধরে পিঠের ওপর কয়েকটি ঘুষি মেরে বলেন, “বল, আমার নামে কী বলেছিস।” একই জবাব পেয়ে ওই শিক্ষক ডাস্টার দিয়ে মারেন এবং লাথি দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেন নাদিমকে। এতে অচেতন হয়ে পড়ে নাদিম।
পরে সংজ্ঞা ফিরে পেলে নাদিমকে টেনে-হিঁচড়ে চার তলা থেকে ছয় তলায় গণিত শিক্ষকদের কক্ষে যান জাওশেদ। পরে কাউকে কিছু না বলার জন্য শাসিয়ে নাদিমকে শ্রেণিকক্ষে পাঠান তিনি।
নাদিমকে নির্যাতনের ঘটনায় আজ সোমবার সকালে প্রায় ৫০ জন অভিভাবক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করতে যান। কিন্তু তাদের বিদ্যালয়ের মূল ফটকের ভেতরে ঢুকতে দেয়নি কর্তৃপক্ষ।
একজন অভিভাবকের অভিযোগ, উদয়ন স্কুলের অধ্যক্ষের সঙ্গে তারা কখনোই কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলার সুযোগ পান না।
আরেকজন অভিভাবক বলেন, “আমরা বিশ্বাস করতে চাই, অভিযোগ ওঠা শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বিচার পাওয়া নিয়ে আমাদের সংশয় আছে।”
অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস না দিয়ে উল্টো ওই শিক্ষকের পক্ষে সাফাই গাইছেন অধ্যক্ষ উম্মে সালমা বেগম।
মারধরের বিষয়ে অভিযুক্ত শিক্ষক জাওশেদ আলম বলেন, “ওই শিক্ষার্থী আমাকে সিএনজি বলে ডাক দেয়। বাচ্চারাই আমাকে এ কথা জানায়। পরে আমি তাকে ডেকে এনে হালকা চড়-থাপ্পড় দিয়েছি।”
উদয়ন স্কুলে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা এই প্রথম নয়। ২০১৩ সালের ২২ মে জোর করে নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির কমপক্ষে ৫০ শিক্ষার্থীর ইউনিফর্মের হাতা কেটে দেন ওই বিদ্যালয়ের ভাইস প্রিন্সিপাল ও শ্রমমন্ত্রী রাজিউদ্দীন আহমেদ রাজুর স্ত্রী মাহবুবা খানম কল্পনা। ওই ঘটনায় সারা দেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধে ২০১০ সালের ৯ আগস্ট সরকার একটি পরিপত্র জারি করে।
কিন্তু দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো শারীরিক শাস্তি চলছে। উদয়ন বিদ্যালয়ের ঘটনাটির এক দিন পর গত শুক্রবার ফেনীতে এক মাদ্রাসাশিক্ষার্থীকে ফ্যানে ঝুলিয়ে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেন শিক্ষক। আরিফ নামের ওই শিক্ষার্থীর অপরাধ সে বাড়ি যাওয়ার জন্য ছুটি চেয়েছিল।
সূত্র: ঢাকা টাইমস ২৪ ডট কম