পশ্চিমা দর্শনের জনক সক্রেটিসের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে। তিনি বলেছিলেন, আমি একটি জিনিসই জানি। তা হলো, আমি কিছুই জানি না। আপনি যত কাছে থেকে দেখার চেষ্টার করবেন, ততই নতুন কিছু বিষয় উঠে আসবে। এগুলো প্যারাডক্স , আপাতবিরোধী হলেও সত্য। এখানে জেনে নিন এমনই ১৫টি প্যারাডক্স যা আপনার মস্তিষ্ক এলোমেলো করে দেবে।
১. গন্তব্যে যেতে হলে প্রথমে তার অর্ধেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এর পর বাকি পথের অর্ধেক যাবেন। এভাবে যতটুকু বাকি থাকে তার অর্ধেক পথ এগোতে হবে। এভাবে অনন্তকাল আপনি যেতেই থাকবেন। অর্থাৎ, এখানে গতিশীল অবস্থা অসম্ভব। এমন বৈপরীত্য সম্পন্ন প্যারাডক্স উঠে আসে প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক জেনোর হাত ধরে। বহুকাল ধরে এ তত্ত্ব মানুষ অগ্রহনযোগ্য বলে গণ্য করে আসছে। তবে ১৯ শো শতকের দিকে এর গাণিতিক ব্যাখ্য দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কোনভাবেই সমাধান হয়নি যে, এ পদ্ধতিতে একটি বস্তু কিভাবে তার গন্তব্যে পৌঁছবে।
২. যেকোনো মুহূর্তে একটি গতিশীল বস্তু এবং স্থির বস্তুর মধ্যে অবস্থার কোনো পার্থক্য নেই। গতির বিরুদ্ধে এটা জেনোসের আরেকটি ধোঁয়াশা। এখানে মুহূর্ত বলে ওই সময়ের শূন্য সেকেন্ড বোঝাচ্ছে। কাজেই শূন্য সেকেন্ডে গতি হবে শূন্য। একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে সময় ধরলে সেখানে বস্তু স্থিরই থাকবে। এই পরস্পরবিরোধী প্যারাডক্স আধুনিক কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
৩. একটি কাঠের জাহাজের প্রতিটা অংশ যদি আবারো জোড়া লাগানো হয়, তবে তা কি ঠিক আগের অবস্থায় ফেরত যাবে? প্রাচীন গ্রিসে আরেকটি ক্লাসিক প্যারাডক্সের নমুনা এটি। অনেকের মতে একই জিনিস যদি একইভাবে জুড়ে দেওয়া হয়, তবে আগের মতোই হবে। অন্য দলের যুক্তি হলো, এটা কখনোই আগের মতো হবে না।
৪. অসীম ক্ষমতার অধিকারী কোনো অস্তিত্ব কি এমন ভারী পাথর বা বস্তু সৃষ্টি করতে পারবে যাকে সে নিজেই তুলতে পারবে না? অনেকের প্রশ্ন হলো, যদি ঈশ্বর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন, তবে অশুভ শক্তি কিভাবে টিকে আছে? আবার ঈশ্বর যদি সর্বজ্ঞ হন, তবে কিভাবে চিন্তার অস্তিত্ব থাকে? এখানে ঈশ্বর বা সর্বসময় ক্ষমতার অধিকারীকে সংজ্ঞায়িত করতে চাইলে আরো কিছু প্যারাডক্স বেরিয়ে আসে।
৫. অসীম দীর্ঘ একটি শিঙ্গা রয়েছে যার শব্দ সৃষ্টির ক্ষমতা সীমিত। কিন্তু এর শব্দ ছড়িয়ে পড়ার স্থান অসীম। ১৭ শো শতকে এই প্যারাডক্সটি বহু সমস্যার সৃষ্টি করে। গণিতের ক্যালকুলাস পদ্ধতির সাহায্যে স্থান এবং এর আয়তনের পরিমাপ পাওয়া যেতে পারে। একটি শিঙ্গা যদি অনুভূমিকভাবে থেকে অনুভূমিক অক্ষে ঘুরতে পারে, তবে এর শব্দ সৃষ্টি অসীম হতে পারে যার মান ‘π (পাই)’ এর সমান। আবার এই শব্দ ভেসে বেড়ানোর এলাকাও হবে অসীম।
৬. যে শব্দ নিজের অর্থ প্রকাশ করে না তাকে বলে ‘হেটেরোলজিক্যাল’ শব্দ। কিন্তু ‘হেটেরোলজিক্যাল’ শব্দটা কি নিজেকে ব্যাখ্যা করতে পারে? এমনই একটি শব্দ ইংরেজিতে ‘verb’। এ শব্দটি নিজে ক্রিয়াপদ নয়, অনেকটা বিশেষ্যের বিপরীত। কিন্তু এটা নিজেই একটি বিশেষ্য। কাজেই ‘হেটেরোলজিক্যাল’ শব্দটা কি নিজেই ‘হেটেরোলজিক্যাল’? এমন কোনো শব্দ যা নিজের অর্থ প্রকাশ করে না, তা নিজেই নিজেকে ব্যাখ্যা করবে। যদি শব্দটি নিজেকে ব্যাখ্যা করে, তবে এমন কোনো শব্দ পাওয়া যাবে যার দ্বারা ওই শব্দের ব্যাখ্যা পরিষ্কার হবে।
৭. মানসিক অসুস্থতার কারণে পাইলট তার দায়িত্ব থেকে সরে যেতে পারেন। কিন্তু কেউ তার দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে চাইলে প্রমাণ হয় যে তিনি সুস্থমস্তিষ্কে রয়েছেন। এক প্রধান পাইলট ইয়োসারিয়ানকে এই প্যারাডক্সের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। এর দ্বারা তিনি অন্য পাইলটদের মূল্যায়ন করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত একে আপাতবিরোধী বলেই গণ্য করেন।
৮. প্রতিটি সংখ্যার পেছনে দারুণ কিছু রয়েছে। ১ হচ্ছে প্রথম অশূন্য প্রাকৃতিক নম্বর। ২ সবচেয়ে ছোট মৌলিক শব্দ। এভাবে সব শব্দের পেছনে মজার বিষয় রয়েছে।
৯. একটি বারে অন্তত একজন ক্রেতা রয়েছেন। এ সত্যটি তখনই সত্য হবে যখন অন্য কেউ সেখানে পানরত রয়েছেন। এভাবে একজন ক্রেতা পান করছেন এবং প্রত্যেকে পান করছেন। সাধারণ যুক্তিতে শর্তসাপেক্ষের বিবৃতিতে ব্যাখ্যা হতে পারে অনির্দিষ্ট। এ ক্ষেত্রে পানের প্যারাডক্স দারুণ এক উদাহরণ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, একজন ক্রেতা বাকিদের পানের কারণ হয়।
১০. একটি বলকে সসীম টুকরায় ভাগ করা গেলে তাদের দিয়ে একই আকারের দুটো বল বানানো যাবে। বানাচ-তারস্কি প্যারাডক্সে বহু অদ্ভুত ও পরস্পরবিরোধী উপাদান রয়েছে। জ্যামিতিক আকৃতি দিতে এর অসীম সংখ্যক পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়।
১১. একটি ১০০ গ্রাম ওজনের আলুতে ৯৯ শতাংশ পানি থাকে। একে শুকিয়ে ৯৮ শতাংশ পানি করা হলে আলুর ওজন ৫০ গ্রাম হবে। পুরনো ধাঁচের অসীম সংখ্যা নিয়ে কাজ করলে গণিত অদ্ভুত ফলাফল দেয়। এই প্যারাডক্সের ব্যাখ্যাটি এমন- আলুটির ৯৯ শতাংশ পানি। অর্থাৎ বাকি ১ শতাংশ আলুর উপাদান রয়েছে। আলুর ওজন ১০০ গ্রাম। তাহলে এতে শুকনো অংশ রয়েছে ১ গ্রাম। যখন আলু শুকিয়ে ৯৮ শতাংশ হয়েছে, তখন এর ১ গ্রাম শুকনো অংশ হয়েছে ২ শতাংশ। আর ১ গ্রাম হলো ৫০ গ্রামের ২ শতাংশের সমান। কাজেই শুকানোর পর আলুর ওজন হবে ৫০ গ্রাম।
১২. যদি একটি কক্ষে ২৩ জন মানুষকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তবে সম্ভাবনা রয়েছে অন্তত এদের মধ্যে ২ জনের একই দিন জন্মদিন হবে। এই হিসাবের সঙ্গে সম্ভাবনার গণিত জড়িত। একটি কক্ষে ২ জন থাকলে তাদের একই দিনে জন্মদিন না হওয়ার সম্ভাবনা ৩৬৪/৩৬৫। আবার ৩ জন হলে তাদের একই দিন জন্মদিন না হওয়ার সম্ভাবনা ৩৬৪/৩৬৫ x ৩৬৩/৩৬৫। এভাবে একজন একজন করে যোগ করতে থাকলে যখন ২৩ জন হবে, এদের জন্মদিনের ভিন্নতার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ কমে আসবে। এ ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২ জনের একই দিন জন্মদিন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
১৩. বেশিরভাগ মানুষের বন্ধুর সংখ্যা তাদের নিজের বন্ধুর সংখ্যার চেয়েও বেশি। অধিকাংশ মানুষেরই বেশ কয়েকজন করে বন্ধু রয়েছেন। আর একসঙ্গে থাকা অনেকগুলো মানুষের আরো বেশি বন্ধু থাকবে।
সূত্র : কালেরকন্ঠ