দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি আধা সরকারি হয়ে যাচ্ছে? শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক কিছু উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা এমন প্রশ্নই তুলছেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ সংশোধন করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ট্রাস্টি বোর্ডে সরকারের প্রতিনিধি ঢোকানোর প্রক্রিয়া শুরু করা এবং শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি সরকার ঠিক করে দেওয়ার কথা বলায় এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত।
উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, আমলারা নানাভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মান দেখভালের পরিবর্তে বা এগুলোর সুষ্ঠু বিকাশে সহায়ক ভূমিকার বদলে নিয়ন্ত্রণের দিকেই আমলাদের ঝোঁক।
দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৯১টি। এগুলোতে সাড়ে তিন লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন।
বেসরকারি পর্যায়ের উচ্চশিক্ষা নিয়ে নানা আলোচনা ও সমালোচনার মধ্যে সরকার, শিক্ষাবিদ, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবাই একবাক্যে শিকার করেন যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করছে। তা ছাড়া আগে যেখানে হাতেগোনা দুচারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মানসম্মত শিক্ষা দিতে, এখন ওই সংখ্যা এক ডজনেরও বেশি।
আইন সংশোধনে কমিটি
সর্বশেষ ২০১০ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধন হয়, যেটির মূল আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল ১৯৯২ সালে। গত অক্টোবরে অনুষ্ঠিত শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির ১২তম বৈঠকে আইনটি সংশোধনে পাঁচ সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। গত ৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির ১৩তম বৈঠকেও এ বিষয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া ইউজিসি চেয়ারম্যান নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি কাজ শুরু করেছে।
এসব উদ্যোগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা বা মালিকদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তারা বলছেন, এ ধরনের সংশোধনী আনা হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়বে। ফলে কার্যত এগুলো আধা সরকারি হয়ে যাবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ সালে সংশোধন করার সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয় টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছিল। মন্ত্রিসভার বৈঠকেও বিষয়টি পাস হয়। কিন্তু উদ্যোক্তাদের দাবির মুখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি এ বিষয়টি বাদ দেওয়ার সুপারিশ করে। তাদের সেই সুপারিশ বহাল রেখে আইনটি পাস হয়।
তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোক্তাদের আপত্তি উপেক্ষা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি দেওয়ার সিদ্ধান্ত বহাল থাকে। এখন প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন করে প্রতিনিধি আছেন, যাদের অনেকেই ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সরকারের কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে উপস্থিত হলেও ভূমিকা রাখতে পারেন না। কেউবা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ধারণাই রাখেন না। আবার কিছু কর্মকর্তা স্রেফ সিন্ডিকেটে যোগ দেওয়ার সম্মানী পেয়েই সন্তুষ্ট থাকেন বলে অভিযোগ আছে।
সিন্ডিকেটে প্রতিনিধি দিয়ে যখন এই অবস্থা, তার মধ্যে ট্রাস্টি বোর্ডে সরকারের প্রতিনিধি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির নেতারা বলছেন, তারা নানারকম আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে এবং বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলেছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারও কোনও সহায়তা দেয় না। কিন্তু নানাভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধনের লক্ষ্যে সভা অনুষ্ঠিত হয়। ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান এতে সভাপতিত্ব করেন। ইউজিসির কর্মকর্তারা ছাড়াও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্যরা ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন।
আইন সংশোধনী কমিটির বৈঠকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আইনে নানা বিধিবিধান যুক্ত করার কথা বলা হয়। কেবল ট্রাস্টি বোর্ডেই নয়, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল, অর্থ কমিটি, শৃঙ্খলা কমিটি, শিক্ষক নিয়োগ কমিটিসহ বিভিন্ন কমিটিতে মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির প্রতিনিধি রাখার বিধান যুক্ত করারও প্রস্তাব করা হয়।
জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, বিভিন্ন মহল থেকে সংশ্লিষ্ট আইনটি সংশোধনের দাবি উঠেছে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতেই আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে সংশোধনী চূড়ান্ত করার আগে সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, আইনে যেসব অসঙ্গতি আছে সেগুলো দূর করার চেষ্টা চলছে। তবে ইউজিসি কেবল সুপারিশ করতে পারে, চূড়ান্ত করার ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের হাতে।
টিউশন ফি নির্ধারণের চিন্তা
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টিউশন ফি নিজেরাই নির্ধারণ করে। সরকার বলছে, টিউশন ফি নির্ধারণের আগে সরকারের অনুমোদন নিতে হবে।
কমিটি গঠনের সত্যতা স্বীকার করে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘বিভিন্ন মহল থেকে জোরালো অভিযোগ উঠেছে-কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে গলাকাটা হারে টিউশন ফি আদায় করা হচ্ছে। এ অবস্থায় টিউশন ফি যৌক্তিক করতে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সুপারিশ দিতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।’
সংসদ সদস্য মো. আবদুল কুদ্দুসকে আহ্বায়ক এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) হেলাল উদ্দিনকে সদস্যসচিব করে ওই কমিটি করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন; ঢাকা-১৩ আসনের সাংসদ জাহাঙ্গীর কবির নানক, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান ও ইউজিসির সাবেক সদস্য অধ্যাপক আতফুল হাই শিবলী।
বৈঠকে সদস্যরা জানান, এ আইন সংশোধন করলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের ইচ্ছামতো ফি আদায় করতে পারবে না। প্রয়োজন ছাড়া ফি বাড়াতে পারবে না। ফলে একই বিষয়ে একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফির ব্যবধান কমে আসবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. আফছারুল আমীন বলেন, ‘কমিটির ১২ ও ১৩তম বৈঠকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফির বিষয়টি এসেছে। আমরা বলেছি, টিউশন ফি কিসের ভিত্তিতে নির্ধারণ হয়, তা কারও জানা নেই। এর একটা নীতিমালা থাকা দরকার। তাই একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সঙ্গে কথা বলে কাজ করবে।’
উল্লেখ্য, চলতি বছর বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফির ওপর সাড়ে সাত শতাংশ ভ্যাট বসানোর পর ব্যাপক আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের একপর্যায়ে সরকার এই ভ্যাট প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। এর পরই টিউশন ফির লাগাম টানার উদ্যোগ নেয় সরকার।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে সরকারের প্রতিনিধি তো আছেনই। এখন ট্রাস্টি বোর্ডে সরকারের প্রতিনিধি দিতে হবে কেন? তার মতে, এটা করা হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্র পরিচিতি আর থাকবে না।
শেখ কবির মনে করেন, টিউশন ফি নির্ধারণের বিষয়টি আইনে রাখার মানে নেই। বরং উদ্যোক্তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করে বড়জোর একটি নীতিমালা হতে পারে।
স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার সময় এক বছর
আইন সংশোধনের এই উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে না পারা ৪৫টি বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। চতুর্থবারের মতো সময় দিয়ে ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, আগামী বছরের জানুয়ারির মধ্যে তাদের নিজস্ব ক্যাম্পাসে যেতে হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ১৪ জানুয়ারি স্বাক্ষর করা ওই চিঠি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তা পেয়েছে। এর পাশাপাশি ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ায় তাদের ধন্যবাদ জানানো হয়েছে।
জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, নিজস্ব ক্যাম্পাসে যারা গেছে তাদের ধন্যবাদ দেওয়া হয়েছে। বেশ কয়েকটি যাওয়ার চেষ্টা করছে বলে তাদের সময় দেওয়া হয়েছে। তবে যেগুলো একেবারেই শর্ত মানবে না, সেগুলোর বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র: banglatribune.com ১৩:৩৭, জানুয়ারি ২৫, ২০১৬