বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে পা রেখেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্কুল শিক্ষক বাবার একার আয়ে সংসার চলত। মধ্যবিত্ত পরিবারে খানিকটা আর্থিক অনটন তো ছিলই। তাই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই নিজের খরচ মেটাতে টিউশনি করতাম। পাশাপাশি চলছিল ভালো একটি চাকরির জন্য নিজেকে গড়ার প্রস্তুতি পর্ব। চোর-পুলিশ খেলার মতো নেহাত খেলার ছলেই ২০০৮ সালের শেষের দিকে যোগ দিয়েছিলাম বাংলাদেশ পুলিশে।
এ চাকরির আগে কোনো প্রতিষ্ঠানে আবেদন বা ভাইভা বোর্ড ফেস করা হয়নি।
থাকতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে। ক্লাস না থাকলেও সকালেই বেড়িয়ে পড়তাম। বইপোকা ছিলাম, বুঁদ হয়ে পড়ে থাকতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে।
বরিশাল গিয়েছিলাম বেড়াতে। এক বন্ধুর মারফত খবর পেয়ে সরাসরি গিয়ে দাঁড়ালাম বরিশাল পুলিশ লাইনে। ঠিক যেন রথ দেখা ও কলা বেচা। দৌড় দিয়ে প্রমাণ করলাম বডি ফিটনেস। বাছাইয়ে টিকে গেলাম। এরপর অংশ নিলাম লিখিত পরীক্ষায়। প্রস্তুতি নেওয়ার সময় লক্ষ করেছি, পুলিশের বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে তেমন একটা তফাত নেই। শুধু প্যাটার্নটা বুঝতে পারলেই হলো। বিগত পরীক্ষার প্রশ্ন ঘেঁটে স্পষ্ট ধারণা নিয়েছিলাম। এর সঙ্গে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি ও সিলেবাসের বাইরের বইয়ের জ্ঞান কাজে লেগেছিল।
পুলিশ সদর দপ্তরে ভাইভা বোর্ডে ছিলেন তিনজন। তাঁদের প্রথম প্রশ্ন ছিল, পুলিশে আসতে চাও কেন? আমি বলেছিলাম, চ্যালেঞ্জ নিতে। পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লেন, তুমি কি সেই চ্যালেঞ্জ নিতে পারবে? দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলাম, পথটা একেবারে সহজ নয়, তবু সেই চ্যালেঞ্জটা লুফে নিয়েই কাজ করতে চাই। এরপর ইংরেজি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ থেকে অনেক প্রশ্ন করেছিলেন। পরীক্ষকরা কোনো প্রশ্ন করেই আমাকে নজেহাল করতে পারেননি। তাই প্রায় নিশ্চিত ছিলাম চাকরির ব্যাপারে।
পুলিশ সদর দপ্তরের কনফার্মেশন লেটারের পর বরিশাল ডিআইজি অফিস থেকে সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হলো। বিসিএসের স্বপ্ন ঝেড়ে ফেলে এ চাকরিতেই মনস্থির করলাম। প্রশিক্ষণের আগে বিপত্তি ঘটল বইপত্র ও পোশাকপরিচ্ছদ কেনার টাকা নিয়ে। তা জুটেছিল গ্রামীণ ব্যাংক শিক্ষা লোন আর পরিবারের সহযোগিতায়। প্রশিক্ষণের সময় বাবা মাসে মাসে টাকা পাঠাতেন। যখন সারদায় প্রশিক্ষণে ছিলাম তখন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে প্রিন্সিপাল মাজহারুল ইসলাম স্যারের লেকচার শুনতাম। মনে হতো ভার্সিটির টিচাররাও এতটা সুন্দর করে ক্লাস নিতেন না। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর দুপুরে ঘুম পেলেও সবাই হাঁ করে স্যারের লেকচার গিলতাম।
প্রথম কর্মদিবসে বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানায় যোগ দেওয়ার পর সে সময়ের ওসি স্যার বলেছিলেন, কাজ শেখার কোনো বিকল্প নেই। নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা, এমনকি থানার বকশির কাছ থেকেও কাজ শিখতে হবে। প্রতিনিয়ত শিখে চলেছি। সবার আন্তরিকতায় তা সহজ হয়েছে।
অনেকে পুলিশকে খারাপ চোখে দেখলেও আমার কিন্তু বেশ কিছু মজার অভিজ্ঞতা রয়েছে। একবার আদালতের ক্রোক পরোয়ানা তামিল করতে গিয়েছিলাম বরিশালের রূপাতলী এলাকায় এক চুরি মামলার আসামির বাড়িতে। গিয়ে দেখি আসামি ঢাকায় থাকে, পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। বৃদ্ধ বাবা স মিলে কাজ করে কায়ক্লেশে সংসারের ঘানি টানছেন। ঘরের যা আছে, নিজের পরিশ্রমে গড়া। সেই পরিবারের ফরিয়াদ শুনে স্থানীয় কাউন্সিলরের সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্রোক করার মতো আসামির কোনো ব্যক্তিগত সম্পদ নেই বলে আদালতে রিপোর্ট দিই। এরপর সেই বৃদ্ধ বাবা খুশি হয়ে তিন হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলেন। তাঁকে প্রশ্ন করি, আপনার কাছে কি আমি কোনো টাকা চেয়েছি? আমাকে আশীর্বাদ করুন। সেটাই আমার জন্য বড় উপহার। তাঁরা কেঁদে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, আজ জানলাম পুলিশও টাকা ছাড়া মানুষের সহযোগিতা করে!
সারদায় প্রশিক্ষণের সময় এক সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার বলছিলেন, তোমরা আইনের রক্ষক। চাইলেই একজনকে অপরাধী সন্দেহ করে হাতকড়া পরিয়ে গারদে পুরতে পারো। সে ক্ষমতার অপব্যবহার করবে না। সেই কথাগুলো আজও কানে বাজে। তাই কাউকে আটক করতে গেল আগে বিবেকের কাছে প্রশ্ন করি, যাকে আটক করতে যাচ্ছি সে আসলেই কি অপরাধ করেছে? সেবার বদলে কেউ যেন আমার দ্বারা হয়রানির শিকার না হয় এটা নিশ্চিত করতে নিজের কাছে ওয়াদাবদ্ধ।
দেখতে দেখতে চাকরির প্রায় ছয় বছর কেটে গেল। মনে হয় এই তো সেদিন জয়েন করলাম। এর মধ্যেই ইন্সপেক্টরশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি কৃতিত্বের সঙ্গে। এখন শুধু দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণের অপেক্ষায় প্রহর গুনছি।
শিক্ষিকা স্ত্রী ও পুত্র সৌম্যজ্যোতিকে নিয়ে কেটে যাচ্ছে জীবন। সারা রাত ডিউটি করে যখন বাসায় ফিরে একটু বিছানায় গা এলিয়ে দিই তখন আবার কাজের ডাক পড়লে সব ছেড়েছুড়ে বেরিয়ে পড়তে হয়। কাজের মধ্যেই খুঁজে নিই আনন্দ। সময় দিতে না পারায় পরিবারের অভিযোগ থাকলেও দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ আমাকে ছুটি দেয় না।
সূত্র: কালের কণ্ঠ