বছরের শুরুতেই থমকে গেছে শিক্ষা ব্যবস্থা। অবরোধ আর হরতালে বিপর্যস্ত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৫ কোটি শিশুর শিক্ষাজীবন। তাদের সামনে এখন শুধুই অন্ধকার। স্কুল ও কলেজ খোলা থাকলেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি খুবই কম। নারী শিক্ষকদের উপস্থিতিও অনিয়মিত। পেট্রোল বোমা হামলা আর সহিংসতার আশঙ্কায় রাজধানীসহ জেলা সদরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনও পুরোপুরি ক্লাস শুরু হয়নি। অভিভাবকরা সন্তানদের নিয়ে শঙ্কিত, দিশেহারা। ২ ফেব্রুয়ারি এসএসসি ও ১ এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা। রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে এ দুটি পরীক্ষার ২৬ লাখ পরীক্ষার্থীর প্রস্তুতি আর মনোসংযোগেও বিঘ্ন ঘটছে। তাদের নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশেষ ক্লাস আর কোচিংও বন্ধ। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর একাডেমিক কার্যক্রমও বন্ধ প্রায়। পিছিয়ে যাচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন পরীক্ষাও। এ পরিস্থিতিতে দুর্ভাবনার পাশাপাশি ক্ষোভ দেখা দিয়েছে সাধারণ অভিভাবকদের মনে। তারা এ পরিস্থিতির দ্রুত অবসান চান। ৫ জানুয়ারি থেকে বিএনপির ডাকা চলমান এ অবরোধ শেষ হওয়ার কোনো .লক্ষণ নেই। একই সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন জেলায় পালিত হচ্ছে হরতাল। অবরোধে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় প্রায় প্রতিদিনই যাত্রীবাহী যানবাহনে পেট্রোল বোমা হামলা ও অগি্নসংযোগের ঘটনা ঘটছে। শিশু, নারী, শিক্ষার্থীসহ সব শ্রেণীপেশার মানুষই হচ্ছেন নৃশংসতার শিকার। অবরোধ-সংশ্লিষ্ট ঘটনায় সারাদেশে এ পর্যন্ত শিশুসহ অন্তত ২৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
গতকাল অবরোধের সঙ্গে হরতালের কারণে রাজধানীর বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী উপস্থিতি ছিল খুবই কম। কয়েকটি বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, শিক্ষার্থী না থাকায় শিক্ষকরা আলোচনা আর আড্ডায় অলস সময় পার করছেন। বারিধারায় সাউথপয়েন্ট স্কুল হরতালের কারণে বন্ধ রাখা হয়েছে। শিক্ষকরা জানান, অবরোধের কারণে আগে থেকেই শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম ছিল। দু’দিনের হরতাল থাকায় সহিংসতার আশঙ্কায় আগেভাগে কর্তৃপক্ষ ছুটি ঘোষণা করেছেন। মিরপুর এমডিসি মডেল একাডেমি, মিরপুর বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়, ন্যাশনাল বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়, জান্নাত একাডেমি হাইস্কুল, মনিপুর স্কুল, লালবাগ ওয়েস্টএন্ড হাইস্কুল, আজিমপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল, ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ হাইস্কুলসহ প্রতিটি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল নগণ্য। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম সমকালকে বলেন, কিছু শিক্ষার্থী এলেও গতকাল কোনো ক্লাস হয়নি। ভয়ে বাবা-মায়েরা সন্তানদের নিয়ে আসতে চান না। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তারা শুক্র ও শনিবার ছুটির দিনে ক্লাস নেবেন। ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ সুফিয়া খাতুন বলেন, অভিভাবকদের মাঝে যে তীব্র শঙ্কা ভর করেছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ অবস্থায় জোর করে শিক্ষার্থী উপস্থিতি নিশ্চিত করার উপায়ই নেই। আসার পথে কোনো ছাত্রীর অপ্রীতিকর কিছু ঘটে গেলে কে তার দায়-দায়িত্ব নেবে?
রাজধানীর খ্যাতনামা ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় স্কলাসটিকার অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার (অব.) কায়সার আহমেদ সমকালকে বলেন, রাজনৈতিক ডামাডোলে ছাত্রছাত্রীদের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। স্কলাসটিকায় ৬ জানুয়ারি ক্লাস শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। এখন তারা শিক্ষার্থীদের হোম টাস্ক দিচ্ছেন। তবে ক্লাস রুম টিচিং বাদ দিয়ে কেবল হোম টাস্ক দিয়ে তো পড়াশোনা করানো যায় না। ধানমণ্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ইনছান আলী বলেন, শিক্ষকরা নিয়মিত আসছেন। তবে ছাত্ররা অনেক কম আসে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হলে হয়তো স্বাভাবিক একাডেমিক কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।
মনিপুর বিদ্যালয়ের রূপনগর শাখার নবম শ্রেণীর ছাত্রী শাহানা আহমেদ সুচি জানায়, স্কুলে খুব কাছে বাসা হওয়ায় সে নির্বিঘ্নে ক্লাসে আসছে। তবে যেসব সহপাঠীর বাসা দূরে, তারা নিয়মিত আসে না। ইডেন সরকারি মহিলা কলেজের দর্শন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ফজিলাতুন্নেছা ফাহিমা বলেন, তাদের কলেজের দুই ছাত্রী বাসে পেট্রোল বোমা হামলায় গুরুতর আহত হওয়ার পর অনাবাসিক ছাত্রীদের ক্লাসে উপস্থিতির সংখ্যা প্রায় তলানিতে। তবে আবাসিক ছাত্রীরা ক্লাসে নিয়মিত।বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান একেএম ছায়েফউল্লা সমকালকে বলেন, স্কুল-কলেজের চেয়ে মাদরাসার পরিস্থিতি মোটামুটি ভালো। সেখানে ক্লাস কম বিঘি্নত হচ্ছে। তবে কিছু কিছু মাদরাসায় নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে না।
অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ :অভিভাবকদের সঙ্গে আলাপকালে তাদের মাঝে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। সাউথপয়েন্ট স্কুলের অভিভাবক আলীমুজ্জামান দীপু জানান, অবরোধে তিনি সন্তানকে বিদ্যালয়ে নিয়ে গেলেও হরতালে নিতে রাজি নন। তিনি বলেন, ‘বোমায় সন্তানের হাত-পা উড়ে গেলে কি রাজনৈতিক দলগুলো তা ফিরিয়ে দেবে? তাদের গণ্ডগোলের নির্মম শিকার আমরা কেন হব?’ ভিকারুননিসার অভিভাবিকা সোফিয়া সুলতানা বলেন, ‘মেয়েকে স্কুলে নিয়ে আসার সময় রিকশায় উঠলেই গা কাঁপে। ভয়ে ভয়ে থাকি। এই বুঝি পেট্রোল বোমা উড়ে এসে পড়ল গায়ে! এ আতঙ্ক আর সহ্য হয় না।’মগবাজারের এনাম কার ডেকোরেশনের স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেন ফোরকান বলেন, বোমা হামলার শুরুর পর থেকে তিনি সন্তানকে স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত রেখেছেন। অভিভাবক ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু সমকালকে বলেন, ‘বছরের শুরুতেই স্কুল, কলেজে লেখাপড়া বন্ধ। শিক্ষার্থী আর আমরা অভিভাবকরা প্রধান দুই রাজনৈতিক জোটের কাছে জিম্মি। তাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বের বলি আমরা হতে চাই না। তারা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করুন। আমাদের মুক্তি দিন। আমরা আমাদের সন্তানদের পূর্ণ নিরাপত্তা চাই।’
শঙ্কায় ১৪ লাখ এসএসসি পরীক্ষার্থী :চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে এসএসসি পরীক্ষার্থীরা। ১১ দিন পর ২ ফেব্রুয়ারি দেশের ১০টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু। সারাদেশের প্রায় ১৪ লাখেরও বেশি পরীক্ষার্থীর এতে অংশ নেওয়ার কথা। টানা রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে এসএসসি পরীক্ষা নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী শুরু হবে কি-না, হলে তা নির্বিঘ্নে ও নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পন্ন করা যাবে কি-না তা নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে সংশয় রয়েছে।
২ ফেব্রুয়ারি পূর্বনির্ধারিত দিনেই পরীক্ষা শুরু হবে কি-না তা নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখনও কিছু জানায়নি। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সমকালকে বলেন, হরতাল-অবরোধের নামে শিক্ষাজীবন ধ্বংস করে আর সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়ে কিসের রাজনীতি? তিনি আশা প্রকাশ করেন, যারা হরতাল-অবরোধের নামে নিরীহ মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলছেন তাদের বিবেক জাগ্রত হবে। তারা তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি পরিহার করে পরীক্ষার স্বার্থে, লাখ লাখ শিক্ষার্থীর জীবনের স্বার্থে এখনই সিদ্ধান্ত নেবেন।
‘এসএসসি পরীক্ষা পেছানো হবে কি-না’ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা কেন লাখ লাখ পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা পিছিয়ে দেব? তারা তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করুন।’এসএসসি পরীক্ষাকালীন পরীক্ষার্থীদের নির্বিঘ্নে নিরাপদে কেন্দ্রে যাতায়াত, পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা, তদারকি ও প্রশ্নপত্র বিতরণের সুষ্ঠু পরিবেশ একান্তই প্রয়োজন বলে পরীক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক সকলেই মনে করছেন।এরই মধ্যে শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান সব জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি) এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) পত্র মারফত পরীক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিধান, কেন্দ্রে উত্তরপত্রসহ পরীক্ষার সরঞ্জামাদির নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ ৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। এরপর ১ এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা। এ পরীক্ষার ১২ লাখ পরীক্ষার্থীর মনেও নানা দুশ্চিন্তা আর উৎকণ্ঠা।নতুন রুটিন দিচ্ছে না জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় :রাজনৈতিক অস্থিরতায় আগামী পরীক্ষাগুলোর নতুন সময় সূচি ঘোষণা আপাতত স্থগিত রেখেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরিস্থিতি দেখেশুনে রুটিন ঘোষণা করা হবে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র সমকালকে জানিয়েছে। এ ব্যাপারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. বদরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা চলমান কোনো পরীক্ষা পেছাইনি। তবে নতুন পরীক্ষার সময়সূচি ঘোষণা স্থগিত রাখা হয়েছে।’ তিনি জানান, আগামী মাসে সারাদেশে ডিগ্রি (পাস) পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারিতে অনার্স পার্ট-২ ও মার্চে অনার্স পার্ট-১ পরীক্ষা হওয়ার কথা। এ তিনটি পরীক্ষায় প্রায় ১০ লাখ পরীক্ষার্থী অংশ নেবে। সময়সূচি ঘোষণা পিছিয়ে গেলে এসব পরীক্ষাও পেছাবে।
মন্ত্রীর বক্তব্য :শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সমকালকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা কোনো দলের নয়, দেশের সম্পদ। তাদের স্বার্থ মানে জাতির স্বার্থ। হরতাল-অবরোধের নামে যারা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছেন, আল্লাহর দোহাই, আপনারা এসব বন্ধ করুন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করলে ইতিহাস আপনাদের ক্ষমা করবে না।’ তিনি বলেন, আমরা আমাদের পরীক্ষার্থীদের নিরাপত্তা চাই, শিক্ষার ব্যাপারে কোনো বাধা মানুষ মেনে নেবে না। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘অহেতুক দুশ্চিন্তা না করে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করো। যথাসময়ে এবং যথা নিয়মে সব পরীক্ষা হবে।’
সৌজন্যে: সমকাল