এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা জাতীয়করণের বিষয়টি নিয়ে দেশে নতুন করে আলোচনা ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
সরকারের নীতিনির্ধারকরাই এ ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি করায় অথবা জড়িয়ে পড়ায় এ নিয়ে দেখা দেয় ব্যাপক কৌতূহল।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জাতীয়করণের আগ্রহ ব্যক্ত করায় মূলত নতুন করে এ ধরনের আলোচনা, বিতর্ক ও কৌতূহলের সূচনা।
গত শতকের আশির দশকের প্রথমার্ধ থেকেই বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীসহ জনমনে একটি কথা ব্যাপকভাবে আলোচিত হতে থাকে, সরকার সহসাই দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কলেজ ও মাধ্যমিক স্কুল জাতীয়করণ করবে।
প্রথমে মনোনীত থানা এবং পরে ধাপে ধাপে যেমন সব মনোনীত থানাকে উপজেলায় রূপান্তরিত করা হয়েছিল, ঠিক একইভাবে এক সময় এমপিওভুক্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের আওতায় চলে আসবে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু না। সাধারণের ধারণা এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি ও প্রত্যাশা অনুযায়ী গত ত্রিশ বছরেও প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয়করণ করা সম্ভব হয়নি।
এ দীর্ঘ সময়ে সরকার (যখন যারা ক্ষমতায় থাকে) অনেকটাই নিজেদের সুবিধা ও খেয়ালখুশি অনুযায়ী কিছুসংখ্যক কলেজ ও মাধ্যমিক স্কুলকে অবশ্য সরকারি/জাতীয়করণ করেছে। এভাবে বিচ্ছিন্ন ঘোষণার মাধ্যমে বাড়তে বাড়তে সারা দেশে বর্তমানে সরকারি কলেজ আনুমানিক তিনশ’ এবং সরকারি মাধ্যমিক স্কুল সোয়া তিনশ’টি। দেশে মোট উপজেলা পাঁচশ’র মতো। লক্ষ্য করার বিষয়, তিন-সোয়া তিনশ’ করে কলেজ ও মাধ্যমিক স্কুল থাকলেও বেশিরভাগ উপজেলাতেই সরকারি পর্যায়ের একটি প্রতিষ্ঠানও (কলেজ বা মাধ্যমিক স্কুল) নেই।
সারা দেশে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা মিলে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে মোট ত্রিশ হাজার; এগুলোতে কর্মরত রয়েছে পাঁচ লাখের বেশি শিক্ষক-কর্মচারী। দিনে দিনে নানাভাবে বেড়ে চলে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যকার বৈষম্য। ক্রমান্বয়ে পরিমাণ বাড়াতে বাড়াতে গত কয়েক বছর ধরে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের একশ’ ভাগ বেতন (মেডিকেল ও বাড়িভাড়া হিসেবে সামান্য ভাতাসহ) সরকারি কোষাগার থেকে দেয়া হচ্ছে। এজন্য আন্দোলন আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের অনেক পথ হাঁটতে হয়েছে। এখন তাদের মূল দাবি জাতীয়করণ।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিটি খুবই পুরনো। তবে আশি ও নব্বইয়ের দশকে আন্দোলনের সময় প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের চেয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের স্কেল অনুযায়ী শতভাগ বেতন প্রদান এবং অন্যান্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিষয়টিই বেশি গুরুত্ব পায়।
১৯৮০ সালে বেসরকারি শিক্ষকদের প্রথমবারের মতো জাতীয় বেতন স্কেলের অন্তর্ভুক্ত করে জিয়াউর রহমান সরকার। এ সময় রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে প্রতি তিন মাস অন্তর তাদের যার যার স্কেল অনুযায়ী ৫০ ভাগ অর্থ দেয়া শুরু হয়।
পরে এরশাদ সরকার (১৯৮২-১৯৯০) ২০ ভাগ বাড়িয়ে ৭০ ভাগে উন্নীত করে। খালেদা জিয়া সরকার তার প্রথম মেয়াদে (১৯৯১-১৯৯৬) বেতনের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে ৮০ ভাগ করে। শেখ হাসিনা সরকার তার প্রথম মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১) আরও ১০ ভাগ বাড়ালে তা ৯০ ভাগে গিয়ে দাঁড়ায়। সর্বশেষ খালেদা জিয়া সরকার (২০০১-২০০৬) সব ভগ্নাংশ উঠিয়ে দিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন স্কেলের ১০০ ভাগ অর্থ প্রদান নিশ্চিত করে। এছাড়া তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ তহবিল সুবিধা ও এককালীন অবসরভাতা পাওয়ার বন্দোবস্ত।
ইদানীং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের জোর তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে এ বিষয়ে এক-একবার এক-একরকম খবর পাওয়া যায়। জানা যায়, বর্তমান সরকারের মেয়াদে বেসরকারি সব এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সরকারিকরণ করা হবে। অন্যদিকে এও জানা যায়, যেসব উপজেলায় কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান নেই, সেখানে একটি স্কুল ও একটি কলেজ সরকারি করা হবে। এক্ষেত্রে উপজেলা সদরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী কলেজ ও পাইলট স্কুলকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। এ লক্ষ্যে কাজও শুরু হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত আগ্রহ ও নির্দেশে গত আগস্ট মাসে তড়িঘড়ি এসব প্রতিষ্ঠানের ‘প্রোফাইল’ তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
পাকিস্তান আমলে, এমনকি স্বাধীনতা লাভের পর সরকারি তহবিল থেকে বেসরকারি একজন কলেজ শিক্ষককে অনুদান হিসেবে দেয়া হতো মাসিক ৫০ টাকা। আর মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকরা পেতেন ৩০ টাকা করে। তখনই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে কলেজগুলো জাতীয়করণের প্রসঙ্গটি প্রথম আলোচনায় আসে।
এ দাবিতে শিক্ষকরা দেশব্যাপী আন্দোলনে নামেন। কলেজে কলেজে ক্লাস বন্ধ রেখে তারা জায়গায় জায়গায় সভা-সমাবেশ করেন। আন্দোলন চলাকালে সরকারের পক্ষ থেকে হিসাব করে বলা হয়, সারা দেশের কলেজগুলো জাতীয়করণ করতে মোট ২০ কোটি টাকার দরকার।
সদ্য স্বাধীন একটি দেশের পক্ষে এ মুহূর্তে ২০ কোটি টাকার ব্যয়ভার বহন করা একেবারে দুঃসাধ্য। কিন্তু কলেজ শিক্ষক সমিতি এই হিসাবের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বলে যে, কলেজ জাতীয়করণের জন্য আসলে এত বেশি টাকার দরকার নেই। সরকারের সীমিত সম্পদের মধ্যে মাত্র ৩ কোটি ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয় করে কলেজগুলো সম্পূর্ণ জাতীয়করণ করা সম্ভব বলে শিক্ষক নেতা শরীফুল ইসলাম ১৫ মে, ১৯৭৩ পত্রপত্রিকায় দেয়া এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে (২০০৯-২০১৪) সরকার গঠন করলে কেবল কলেজ নয়, এমপিওভুক্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা) শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণের বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। তখনও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, এমনকি জাতীয় সংসদে পর্যন্ত আলোচনা হয়, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণ করতে অতিরিক্ত ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন।
এই বক্তব্যের জবাবে শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট’ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া এক বিবৃতিতে বলেন, ‘চাকরি জাতীয়করণে বর্তমান বরাদ্দের তুলনায় বাড়তি কোনো অর্থেরই প্রয়োজন হবে না। অথচ শিক্ষামন্ত্রী কোনো সমীক্ষা ছাড়া তাৎক্ষণিক এক ভুয়া হিসাবের মাধ্যমে ৪০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজনের তথ্য প্রকাশ করেন। … চাকরি জাতীয়করণের জন্য সরকারের কাছ থেকে কোনো অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন নেই। বর্তমানে সরকার শিক্ষকদের যে টাকা দেন তার সঙ্গে প্রায় দুই হাজার পাঁচশ’ কোটি টাকা হলেই চাকরি জাতীয়করণ সম্ভব। সরকার প্রায় ১ কোটি ৩১ লাখ ছাত্রছাত্রীর বেতন, সেশন চার্জ, রিজার্ভ ফান্ড, সাধারণ তহবিল ও অন্যান্য উৎস থেকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা পাবে। চাকরি জাতীয়করণের পরও সরকারের এক হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে’ (যুগান্তর, ১ ফেব্র“য়ারি ২০১৩)।
সম্প্রতি অবসরে যাওয়া শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান ২৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার দফতরে দেখা করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী এক পর্যায়ে দেশে মোট কয়টি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা রয়েছে এবং এগুলো জাতীয়করণ করতে সরকারের অতিরিক্ত সর্বমোট কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তা তার কাছে জানতে চান। জবাবে সচিব জানান, ‘খরচ হতে পারে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। আর প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩০ হাজারের মতো।’ সব শুনে প্রধানমন্ত্রী সম্মত হন এবং জাতীয়করণের লক্ষ্যে কাজ শুরু করার দৃঢ় আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন বলে নজরুল ইসলাম খান ‘দৈনিক শিক্ষাডটকম’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন।
এর মাত্র দু’দিন পর ২ ডিসেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সরকারের দু’জন শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রী বক্তব্য রাখার সময় কলেজগুলো জাতীয়করণের ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য করেন। তাদের একজন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ওই অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় কলেজগুলো জাতীয়করণের ব্যাপারে ঘোর আপত্তির কথা জানান।
অতীতের কথা স্মরণ করলে বোধকরি অনেকটাই স্বস্তি পাওয়া যাবে যে, পেশাগত সুবিধাদির ক্ষেত্রে সত্তর, আশি এমনকি নব্বইয়ের দশকেও বেসরকারি শিক্ষকরা কেমন এবং কোন অবস্থানে ছিলেন।
পাশাপাশি সরকারকেও মনে রাখতে হবে যে, আর্থ-সামাজিক দিক বিবেচনায় আমরা আর আগের অবস্থানে নেই। সামর্থ্য বেড়েছে অনেক।
এখন আমাদের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ অপবাদ দেয়ার কেউ সুযোগ পাবে না। ইতিমধ্যে আমরা মধ্যম আয়ের দেশের কাতারের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। কাজেই বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষকদের প্রতি করণীয় নির্ধারণ করা একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। কোনো বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্ত ভাবনায় নয়, যুগের চাহিদাকে সামনে রেখেই তা করতে হবে।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে যুগোপযোগী ও সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও সঠিক জবাবদিহিতার আওতায় তো আনতেই হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বি সি এস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার।
সূত্র: দৈনিক শিক্ষা