বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় বছরে যত শিক্ষক নিয়োগ হয়, নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস করছেন তার চেয়ে চারগুণ বেশি প্রার্থী। ফলে নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি বাড়ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতি-নির্ধারকদেরই এ উপলব্ধি। তারা মনে করছেন, নিয়োগ নিয়ে নানা অনিয়মের মূল কারণ, অধিকসংখ্যক যোগ্য প্রার্থীর ছড়াছড়ি। শূন্যপদের চেয়ে চাকরিপ্রার্থী বেশি হওয়ায় বেকারত্ব মোচনে তারা মরিয়া হয়ে ওঠেন। আত্মীয়তা, রাজনৈতিক তদবির এমনকি টাকা-পয়সা দিয়েও চাকরি নিতে তারা প্রতিযোগিতায় নামছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাকরি সোনার হরিণ, তাই দুর্নীতি বাড়ছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ‘বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ’ (এনটিআরসিএ) আয়োজিত নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস করতে হয়। বছরে একবার এ পরীক্ষা নেওয়া হয়। দেখা গেছে, সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকের চাহিদা কত তা জানে না এনটিআরসিএ। তারা নির্ধারিত ৪০-এর ঊধর্ে্ব নম্বর পাওয়া সবাইকে পাস করিয়ে ‘ নিবন্ধন সনদ’ দিয়ে দিচ্ছে। এতে চাকরির বাজারে অসম অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন শিক্ষা সচিব মো. নজরুল ইসলাম খানও। তিনি নিজ মন্ত্রণালয়ে সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, ‘চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি হলে বাজারে সুলভ মূল্যে তা পাওয়া যাবে এটাই নিয়ম। শিক্ষক প্রার্থীরাও এখন সুলভ। অথচ চাকরি সোনার হরিণ। এর সুযোগ নিয়ে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি হচ্ছে। এ কথা কোনো রাখঢাক না করেই বলা যায়। আগামীতে আর কখনোই শূন্য পদের চেয়ে বেশি হারে পাস করিয়ে রাখা হবে না।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, এনটিআরসিএ গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত ১২ বছরে ১২টি পরীক্ষার মাধ্যমে মোট পাঁচ লাখ ৪০ হাজার ৩২৯ জন চাকরিপ্রার্থী পাস করেছেন। তাদের মধ্যে ৬৩ হাজার ৪২ জন চাকরি পেয়েছেন। আর উত্তীর্ণ চার লাখ ৭৭ হাজার ২৮৭ জনই কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার চাকরি পাননি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, এই চার লাখ ৭৭ হাজার চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে সর্বোচ্চ তিন লাখ শিক্ষকতার বাইরে অন্যান্য চাকরি পেতে সক্ষম হয়েছেন। বাকিরা এখনও বেকার।
শিক্ষা সচিব মো. নজরুল ইসলাম খান বলেন, অতীতে শূন্য পদের সংখ্যা যাচাই না করে ঢালাওভাবে পাস করানোর কারণে শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে নানা অনিয়মের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি জানান, বর্তমানে সারাদেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের শূন্য পদের সংখ্যা ৪০ হাজার। আগামী ২৯ অক্টোবরে নিবন্ধন পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হবে। এতে পদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ফল প্রকাশ করা হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত ‘বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশন (নন-গভর্নমেন্ট টিচার্স সিলেকশন কমিশন বা এনটিএসসি)’-এর এসআরও (স্ট্যাটিউটরি রেগুলেটরি অর্ডার) আগামী দু’একদিনের মধ্যে জারি করা হবে। এর মাধ্যমে এ কমিশন গঠিত হবে। কমিশন গঠিত হলে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষক বাছাই ও নির্বাচনের ক্ষমতা হারাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি। এ কমিশনই শিক্ষক নিয়োগের জন্য সারাদেশের প্রার্থীদের নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা গ্রহণ করবে। প্রাথমিক বাছাই (প্রিলিমিনারি), লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে উপজেলাভিত্তিক মেধা তালিকা প্রকাশ করা হবে। একইভাবে জেলাভিত্তিক ও বিভাগভিত্তিকও পৃথক মেধা তালিকা প্রণয়ন করা হবে। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক নিয়োগ দিতে চাইলে ওই থানা/উপজেলার মেধা তালিকা থেকে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। তবে কোনো উপজেলার মেধা তালিকায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ের (সাবজেক্ট) শিক্ষক পাওয়া না গেলে জেলার মেধা তালিকা থেকে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যাবে। জেলার মধ্যেও ওই বিষয়ের শিক্ষক না মিললে সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগের মেধা তালিকা থেকে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। এনটিএসসি পরীক্ষায় একবার পাস করলে তা তিন বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। পাস করার তিন বছরের মধ্যে কোনো
প্রার্থী শিক্ষক হিসেবে কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি না পেলে তাকে আবারও এনটিএসসি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে। জানা গেছে, কমিশনে একজন চেয়ারম্যান ও পাঁচজন সদস্য থাকতে পারেন।
এদিকে, নতুন এ কমিশনে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব দাবি করেছেন বেসরকারি শিক্ষকরা। তারা বলছেন, আমলানির্ভর এ কমিশন গঠন না করে শিক্ষকদের দিয়েই বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিটি গঠন করতে হবে। বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম বৃহৎ মোর্চা শিক্ষক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ মো. শাজাহান আলম সাজু সোমবার সমকালকে বলেন, প্রস্তাবিত এনটিএসসিতে অবশ্যই বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিচালনার অভিজ্ঞতাহীন ব্যক্তিরা কমিশনের সদস্য হলে তাতে শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটবে না।
জানা গেছে, সারাদেশে এ মুহূর্তে ৩০ হাজার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এতে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন।
সূত্র: সমকাল