বিসিএস পরীক্ষায় ভাইভা বা মৌখিক পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ২০০ নম্বরের এই অংশ অনেকাংশেই ক্যাডার নির্ধারণ করতে পারে। এখানে যে ভালো মার্কস তুলতে পারে, সে ভালো ক্যাডার পেয়ে যেতে পারে লিখিত পরীক্ষায় অনেক কম মার্কস নিয়েও।
আমার দৃষ্টিতে এই অংশে একটু সতর্ক প্রস্তুতি নিলেই অনেক নম্বর পাওয়া সম্ভব। এটি খুবই সরল হিসাব, যা হয়তো আমরা প্রত্যেকেই জানি। তাই ভাইভাকে খুবই গুরুত্বসহকারে নেওয়া উচিত। যে প্রার্থী বিসিএসে ভালো ভাইভা দিয়ে থাকে, সে কিছু বিষয়ে অন্যদের থেকে আলাদাভাবে বোর্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। সংগত কারণে বোর্ড সেই প্রার্থীকে অধিক যোগ্য বলে মনে করে থাকে এবং বেশি নম্বর দিয়ে থাকে। কিন্তু ভাইভায় ডাক পাওয়া সবাই জানে না, কোন সব বিষয় তাকে অন্যদের থেকে আলাদাভাবে বোর্ডের কাছে প্রতীয়মান করবে। আগেই বলে রাখি, চাকরিভেদে ভাইভার ধরনও আলাদা হয়ে থাকে। আমরা এখানে নিতান্তই বিসিএস ভাইভা নিয়ে কথা বলছি।
বিসিএস ভাইভা বোর্ডে সাধারণত তিনজন সদস্য থাকেন, যার মধ্যে একজন পিএসসি সদস্য আর বাকি দুজন এক্সটারনাল, অর্থাৎ পিএসসি কর্তৃক আমন্ত্রিত। পিএসসির প্রত্যেক সদস্য আলাদা আলাদা বোর্ডে থাকেন। ক্রমানুসারে বোর্ড পরীক্ষার্থীদের ভাইভার জন্য ডাকে। একজন পরীক্ষার্থীকে যখন বোর্ড ডাকে, তখন তার কিছু তথ্য-উপাত্ত বোর্ডের কাছে থাকে, যা আগে পরীক্ষার্থী পিএসসির কাছে জমা দেয়।
অল্প কিছু বিষয়ে সঠিকভাবে দক্ষতা অর্জন করতে পারলে পরীক্ষার্থীরা ভাইভায় ভালো নম্বর নিশ্চিত করতে পারবেন। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বললে কিছু বিষয়ের দক্ষতা একজন প্রার্থীকে ভালো মার্কসের নিশ্চয়তা দেয়।
ভাইভায় সাধারণত কিছু বিষয় গুরুত্ব দিয়ে সে বিষয় থেকে অনেক প্রশ্ন করা হয়। প্রার্থীভেদে গুরুত্বপূর্ণ অংশের তারতম্যও হতে পারে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমি নিচে উল্লেখ করলাম। এগুলোর ওপর বিশদ প্রস্তুতি নিতে পারেন প্রত্যেক পরীক্ষার্থী :
- নিজ নিজ স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের বিষয় সম্পর্কে ভালোমতো জানা
- পছন্দক্রম অনুসারে ১, ২ ও ৩ নম্বর পছন্দের ক্যাডার সম্পর্কে ধারণা রাখা
- মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস
- সাম্প্রতিক বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি
- বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামো
- বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি
- বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা
- দৈনিক পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ অংশ
- ভূগোলের জ্ঞান
৩৩তম বিসিএসে আমার নিজের ভাইভা বোর্ডে আমাকে আমার স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের বিষয় সম্পর্কিত বেশ কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল। আমি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্র। তাই আমাকে ভারত, চীন, ভুটান, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন ও অস্ট্রেলিয়ার আর্থসামাজিক আর রাজনৈতিক বিষয়ের ওপর প্রশ্ন করা হয়েছিল বেশি।
এসব প্রশ্নের মধ্যে একটা প্রশ্ন ছিল, বোর্নিও দ্বীপে কয়টি দেশ আছে, যা ভূগোলের জ্ঞান ছাড়া উত্তর দেওয়া অসম্ভব। যেদিন ভাইভা ছিল, সেদিনের দৈনিক পত্রিকার বিভিন্ন প্রতিবেদন সম্পর্কে দুই-তিনটি প্রশ্ন করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করা হয়েছিল।
এ ছাড়া আরো অনেক বিষয় নিয়ে বোর্ড প্রশ্ন করতে পারে। ভালো নম্বর পেতে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গভীর জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। অনেক কঠিন বা অনেক সহজ প্রশ্ন করা হতে পারে। সে জন্য সঠিক প্রস্তুতির মাধ্যমে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা উত্তম।
ভাইভার আগে অন্যদের ভাইভার অভিজ্ঞতা শোনা যেতে পারে। তাহলে কোন বোর্ড কী ধরনের প্রশ্ন করে, সে সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি হবে। বিসিএসের প্রতিটি বোর্ডের পরিবেশ কেমন হবে, তা সাধারণত নির্ভর করে সেই বোর্ডে পিএসসির কোন সদস্য থাকেন, তার ওপর। কেননা, সাধারণত বেশির ভাগ প্রশ্ন পিএসসির সদস্যরাই করে থাকেন।
যেহেতু কেউ জানে না, কোন বোর্ডে তার ভাইভা হবে, তাই প্রতিটি বোর্ড সম্পর্কে অগ্রিম ধারণা নিয়ে রাখা ভালো। কারণ, একেকজন সদস্য একেক বিষয়ে অধিক প্রশ্ন করে থাকেন। অন্যদের ভাইভার অভিজ্ঞতা শুনলে বোঝা যায়, বোর্ডের সদস্যরা অনেক সময় একই বিষয়ে অধিক প্রশ্ন করে থাকেন। এই বিষয়টি ভাইভার সময় প্রার্থীকে কিছুটা এগিয়ে রাখবে।
ভাইভায় পোশাক-পরিচ্ছদ নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে বোর্ড প্রার্থী সম্পর্কে অনেক কিছু মূল্যায়ন করতে পারে। পরিপাটি হয়ে ভাইভা দিতে গেলে বোর্ড এ ধারণা পাবে যে প্রার্থী ভাইভাকে গুরুত্বসহকারে নিয়েছেন। তা ছাড়া প্রার্থীর রুচিবোধ সম্পর্কেও ধারণা পাবে। ফরমাল পোশাক বলতে আমরা যা বুঝি, ভাইভায় সাধারণত সে পোশাক পরে যাওয়াই ভালো। পোশাকের রংও নির্বাচন করা উচিত সতর্কতার সঙ্গে। পুরুষরা টাই পরতে পারেন। আর যাঁরা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দাড়ি রাখেন না, তাঁরা ক্লিন শেভড হয়ে যাওয়াই ভালো।
ভাইভা বোর্ডে ঢোকার সময় অনুমতি নিয়ে ঢোকা উচিত। ঢুকে সালাম বা শুভ সকাল/অপরাহ্ণ বলাটা ভালো। হুট করে চেয়ারে না বসে চেয়ারের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে বোর্ডই আপনাকে বসতে বলবে, সে পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত। বসতে বলার পর ধন্যবাদ দেওয়াটা ভদ্রতা। বোর্ডের যে সদস্য প্রশ্ন করবেন, তার দিকে তাকিয়ে উত্তর দেওয়া উত্তম। ভাইভা শেষে ধন্যবাদ বলে স্থান ত্যাগ করা উচিত। রুমে ঢোকা বা বেরোনোর সময় দরজায় জোরে শব্দ না করা ভালো।
ভাইভার ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসের বিপরীত হলো নার্ভাসনেস। আমরা প্রত্যেকেই জানি, আত্মবিশ্বাসী প্রার্থীকে বোর্ড অধিক মার্কস দেয়। কিন্তু আত্মবিশ্বাসী কীভাবে হতে হয়, তা অনেকেই জানি না। এ-সংক্রান্তে আমার নিজস্ব ব্যাখ্যা হলো, যে প্রার্থী সঠিক প্রস্তুতি নেয় বলে নিজে মনে করে, সে অধিক আত্মবিশ্বাসী থাকে। ‘নিখাঁদ আত্মবিশ্বাস’ বলতে কিছু মনে হয় না আছে। সুন্দর প্রস্তুতি অধিক আত্মবিশ্বাস অর্জনে সহায়ক।
যেকোনো প্রশ্নের উত্তর আমরা নানাভাবে দিতে পারি। তবে বিদ্বানরা বলেন, ‘Brevity is the soul of wit’। আমারও মনে হয়, সবচেয়ে সংক্ষিপ্তভাবে সঠিক উত্তর দেওয়াটাই উত্তম। তবে বোর্ড যদি কোনো বিষয়ে প্রার্থীর মতামত জানতে চায়, সে ক্ষেত্রে বিশদ বর্ণনা দেওয়া যেতে পারে।
উত্তর কোন ভাষায় দেওয়া উচিত, তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই। বোর্ড যে ভাষায় প্রশ্ন করবে, সে ভাষাতেই উত্তর দেওয়া উচিত। আমাদের অনেকের মধ্যেই না জেনে উত্তর দেওয়ার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। এটি বর্জন করা উত্তম। তবে যদি মনে হয়, কোনো উত্তর অনুমান করে বললেও সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তবে ‘স্যার, আমার মনে হয়’ এ কথা বলে উত্তর দেওয়া যেতে পারে।
প্রতিদিন অনেক পরীক্ষার্থী ভাইভা দিতে যায়। তাই প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার দীর্ঘ সময় ধরে নেওয়া বোর্ডের পক্ষে সম্ভব হয় না। যে পরীক্ষার্থীকে বোর্ড সাধারণ মানের মনে করে থাকে, সেই পরীক্ষার্থীকে কম সময় রাখে। কাউকে যদি বোর্ড সম্ভাবনাময় মনে করে, তবে তাকে ২৫-৩০ মিনিটও রাখতে পারে। এমন অনেক উদাহরণ যেমন দেখেছি, ব্যতিক্রমও দেখেছি। ২৫-৩০ মিনিটের ভাইভা দিয়েও ক্যাডার হয়নি এমনটা যেমন দেখেছি, আবার ৫-৭ মিনিটের ভাইভা দিয়েও ক্যাডার হতে দেখেছি।
অনেক ক্ষেত্রেই এমনটা দেখা যায়, প্রার্থীকে যে প্রশ্ন করা হলো, তার উত্তর থেকে বোর্ড পরের প্রশ্ন তৈরি করে। তাই উত্তর দেওয়ার সময় সতর্ক থাকা উচিত। এমন কোনো কিছু বলা উচিত নয়, যা নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন এলে উত্তর দেওয়া কঠিন হবে।
একটা উদাহরণ দিয়ে বললে বুঝতে আরো সুবিধা হবে। আমার ভাইভায় আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভুটানে সর্বশেষ সংসদ নির্বাচন কবে হয়েছে? তার উত্তর থেকে পরের প্রশ্ন ছিল, কোন পার্টি ক্ষমতায় আছে তার ওপর। এই প্রশ্নের উত্তর থেকে পরে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিরোধী দলের পরাজয়ের কারণ নিয়ে। আর এ প্রশ্নের উত্তর থেকে পরের প্রশ্ন ছিল ভুটানের সরকার পদ্ধতি কেমন তার ওপর। তাই সুকৌশলে নিজের উত্তর বলা উচিত, যাতে পরের প্রশ্ন সেই উত্তর থেকে জিজ্ঞেস করলে দেওয়া সম্ভব হয়।
সবশেষে বলে রাখি, ওপরের আলোচনা আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এর বাইরেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকতে পারে, যা ভাইভা প্রস্তুতির সহায়ক। প্রয়োজনে ভাইভা বিষয়ে অভিজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। নিজের কাছে কোনো বিষয় গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে তার ওপরও প্রস্তুতি নিয়ে নিতে হবে।
ধন্যবাদ।
লেখক : এএসপি (প্রবেশনার), ৩৩তম বিসিএস।
সূত্র: এনটিভি বিডি ডট কম