প্রতীক্ষার প্রহর আর শেষ হতে চায় না। পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর থেকেই এই প্রতীক্ষা—এই বুঝি চিঠি এলো। কিন্তু চিঠি বা নিয়োগপত্র আর আসে না। মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে হাজির হন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের পরিদর্শক। তাঁদের হম্বিতম্বি শেষ না হতেই উপস্থিত হন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তরের (এনএসআই) কর্মকর্তারা। প্রতীক্ষা আর পুলিশ-গোয়েন্দাদের জেরার চাপে জেরবার চাকরিপ্রার্থীরা। মূলত এই প্রতীক্ষা আর চাপের শুরু হয়েছে ৩৯ মাস আগে। সেদিন পিএসসি ৩৪তম বিসিএসের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল।
একটি নিয়োগের মূল কাজ লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে প্রার্থী বাছাই করা। আনুষঙ্গিক কাজ হচ্ছে প্রার্থী যেসব ব্যক্তিগত তথ্য দিয়েছেন তা যাচাই-বাছাই করা। পিএসসি নিয়োগের জন্য প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে গত ১৫ সেপ্টেম্বর দুই হাজার ১৭৫ জন প্রার্থীকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠায়। আনুষঙ্গিক কাজ অর্থাৎ যাচাই-বাছাই শেষ করে মন্ত্রণালয় শুধু নিয়োগপত্র ইস্যু করবে। কিন্তু মূল কাজ শেষে আনুষঙ্গিক কাজেই সব কিছু আটকে আছে। স্পেশাল ব্রাঞ্চ তাদের প্রতিবেদন দিলেও প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের পূর্ণাঙ্গ তালিকা দেয়নি এনএসআই। দুই হাজার ১৭৫ জন প্রার্থীর মধ্যে এখনো পাঁচ শতাধিক প্রার্থীর যাচাই-বাছাইকৃত তথ্য এনএসআই জনপ্রশাসনকে দিতে পারেনি।
সময়মতো প্রার্থীর তথ্য যাচাই-বাছাই কেন করতে পারেনি এনএসআই? রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট এই সংস্থার জনবল সমস্যা রয়েছে বলে জানা গেছে। এ কারণেই জনপ্রশাসনের বেঁধে দেওয়া সময়ে তারা তথ্য সরবরাহ করতে পারেনি।
৩৪তম বিসিএসে ২৯২ জন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য বিভিন্ন ক্যাডারে সুযোগ পেয়েছেন। এর মধ্যে ২৭২ জনের প্রতিবেদন পাঠিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। অবশিষ্ট ২০ জনের তথ্যের জন্য বসে আছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এই ২০ জন চরম উদ্বেগের মধ্যে দিন পার করছেন। গত সোমবার এই ২০ জন প্রার্থী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে দ্রুত তাঁদের সমস্যা সমাধানের তাগিদ দিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২৯২ জনের তথ্য যাচাই-বাছাই করতে কেন সাত মাস সময় লাগিয়েছে জানতে চাইলে এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখানেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গাফিলতি রয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ক্যাডার কর্মকর্তাদের পোস্টিং দেয়। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে কয়েকজন চৌকস ক্যাডার কর্মকর্তাকে সেখানে পোস্টিং দেওয়ার অনুরোধ করে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চৌকস কর্মকর্তা বাছাই করতে গিয়ে নন-ক্যাডার কর্মকর্তা বাছাই করেছে। নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা চাকরিজীবনের শেষ মুহৃর্তে এসে পদোন্নতি পেয়েছেন। তাঁরা এখন চাকরিজীবনের সায়াহ্নে অবস্থান করছেন। চৌকস ক্যাডার কর্মকর্তার বদলে এখন এসব নন-ক্যাডার অদক্ষ কর্মকর্তা নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাড়ার কারণে তাঁদের সনদ যাচাই-বাছাইয়ের কাজও বেড়েছে বহুগুণ। কিন্তু সে তুলনায় মন্ত্রণালয়টির জনবল একেবারেই কম। ১৪৯ জন জনবল নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
শুধু ৩৪তম বিসিএসই নয়, এখনো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৩৩তম বিসিএসের নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে পারেনি। ২০১২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি চার হাজার ২০৬টি পদ পূরণের জন্য ৩৩তম বিসিএসের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পিএসসি। ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর আট হাজার ৫২৯ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করে পিএসসি। ৩৩তম বিসিএসের একজন প্রার্থী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার সব কিছুই ঠিক আছে। তার পরও নিয়োগপত্র হাতে পাইনি। কবে পাব জানি না। আমার চাকরির বয়সও আর নেই। কোনো কারণে এই নিয়োগটা না হলে সব কিছু শেষ হয়ে যাবে।’
চাকরির দাবিতে শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে প্রতিবাদ করেছেন ৩৪তম বিসিএসের একজন চাকরিপ্রার্থী। ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নন-ক্যাডারদের চাকরির দাবিতে এই প্রতিবাদ করেছেন তিনি। এই চাকরিপ্রার্থীর নাম নূর ইসলাম নূর। আগুনে দগ্ধ নূর ইসলাম নূর ‘৩৪তম বিসিএস পাস ক্যাডার বঞ্চিত ফোরাম’-এর সমন্বয়ক। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার দুপুরে রাজধানীর শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরের সামনে ‘৩৪তম বিসিএস পাস ক্যাডার বঞ্চিত ফোরাম’ ব্যানারে ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষার ফলাফলে কোটা পদ্ধতি সঠিকভাবে অনুসরণ এবং ৬৭২টি শূন্য পদে উত্তীর্ণ হয়েও বঞ্চিতদের ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের এবং সব নন-ক্যাডারের চাকরির দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে ফোরামটি। তারা পিএসসির দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দেয়। এরপর তারা প্রজন্ম চত্বর থেকে শাহবাগ মোড় অবরোধ করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়।
এ সময় ওই চাকরিপ্রার্থী নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। অন্য প্রার্থীদের চেষ্টায় আগুন নেভানো হলেও তাঁর হাত এবং পেটের চামড়া পুড়ে যায়। পরে পুলিশ জোর করে আহত নূরকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেয়। ওই অবস্থান কর্মসূচি থেকে ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নন-ক্যাডার শিক্ষার্থীরা সরকারের কাছে তিন দফা দাবি তুলে ধরেন। এগুলো হলো—৩৪তম বিসিএস পরীক্ষার ফলাফলে কোটা পদ্ধতি সঠিকভাবে অনুসরণ করে মেধা ও প্রাধিকার কোটা আলাদা করে পুনরায় ফলাফল প্রকাশ করা, ৩৪তম বিসিএসের কারিগরি ও পেশাগত ক্যাডারের ৬৭২টি শূন্য পদ ৩৪তম বিসিএস পাস নন-ক্যাডার প্রার্থী থেকে পূরণ করা এবং সরকারের প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির শূন্য পদগুলো ৩৪তম বিসিএস নন-ক্যাডারদের দ্বারা পূরণ করা।
এদিকে ৩৪তমের নিয়োগ না দিতে পারলেও বসে নেই পিএসসি। সাংবিধানিক এই সংস্থা বর্তমানে একই সঙ্গে তিনটি বিসিএস পরীক্ষা গ্রহণ করছে। ৩৫তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষাও হয়ে গেছে। প্রার্থীরা ফল প্রকাশের অপেক্ষায়। ৩৬তম বিসিএসের প্রার্থীরা প্রিলিমিনারি শেষে লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর ৩৭তম বিসিএসের আবেদনপত্র নেওয়া শেষ হয়েছে গত মাসে। পিএসসির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা ইচ্ছা করলেই ৩৫তমের রেজাল্ট দিয়ে দিতে পারি। কিন্তু দিয়ে কী হবে? জনপ্রশাসন এখনো ৩৪তমের নিয়োগই দিতে পারেনি। তাই আমরাও ঢিমেতালেই এগোচ্ছি।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, ‘আমরা সব প্রস্তুতি শেষ করে এনেছি। শিগগিরই ৩৪তম বিসিএসের নির্বাচিত প্রার্থীদের নিয়োগপত্র দেওয়া হবে।
সূত্র : দৈনিক কালেরকন্ঠ ৫ মে, ২০১৬।