বন্ধ হয়নি ৯ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈধ ক্যাম্পাস

University_1

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নিয়ে বৈধ ক্যাম্পাসের পাশাপাশি একাধিক অবৈধ আউটার ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে ৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, ছাত্র ও যুবনেতা এবং কয়েকজন শিক্ষাবিদ। ‘বৈধ’ বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব ‘অবৈধ’ ক্যাম্পাস বন্ধে কার্যত নির্বিকার শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। শুধু কয়েকটি নোটিশ পাঠিয়ে দায় সেরেছে ইউজিসি।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান এ প্রসঙ্গে সমকালকে বলেন, অবৈধ আউটার ক্যাম্পাস পরিচালনাকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বেশিরভাগই ইউজিসির দেওয়া নোটিশের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছে। কেউ কেউ স্থগিতাদেশ পেয়েছে। তবে প্রভাবশালীদের এসব মামলার স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করাতে ইউজিসির খুব একটা চেষ্টা নেই বলে মনে করে সংশ্লিষ্ট মহল।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কাগজে-কলমে দেশে এখন ৮৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় এখনও শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। বাকি ৭৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি অনুমোদন ছাড়াই একাধিক আউটার ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, যা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। সরকারি অনুমোদন ছাড়া শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা অবৈধ হলেও আদালতের দোহাই দিয়ে এসব বিশ্ববিদ্যালয় অবৈধ ক্যাম্পাসে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

অবৈধ ক্যাম্পাস পরিচালনাকারী বিশ্ববিদ্যালয় : যে ৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অবৈধ ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে সেগুলো হলো_ দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, দি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (চট্টগ্রাম),
ইবাইস ইউনিভার্সিটি ও আন্তর্জাতিক ইসলামিক ইউনিভার্সিটি (চট্টগ্রাম)। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির কাছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা গত ২৯ জুলাই উপস্থাপন করেছে ইউজিসি। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল কুদ্দুস বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক চিত্র নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অবৈধ ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার মতো গুরুতর অভিযোগও রয়েছে।

জানা গেছে, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চারটি গ্রুপে ভাগ হয়ে সারাদেশে ১০৮টি অবৈধ শাখা খুলে সনদ বিক্রি করছে। প্রতিটি গ্রুপের সঙ্গে সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত। এর মধ্যে একটি পক্ষের ভিসি পদে রয়েছেন সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর আপন ভাই। ওই মন্ত্রী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নানা তদবির করেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ খুলনা এবং ঢাকার মতিঝিলে অবৈধ দুটি ক্যাম্পাস চালাচ্ছে। মৌলবাদী হিসেবে পরিচিত প্রফেসর আবুল হাসান মুহম্মদ সাদেক এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক ও ভিসি। কিন্তু সরকারের একজন মন্ত্রী ও ঢাকা থেকে সাংসদ নির্বাচিত সাবেক এক প্রতিমন্ত্রী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে নানা ভূমিকা পালন করেন। তবে ইউজিসি জানিয়েছে, এ দুটি অবৈধ ক্যাম্পাসের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের জানিয়েছে।
অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মিরপুর, পান্থপথ, উত্তরা ও পুরানা পল্টনে অবৈধ ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে। পুরানা পল্টন ক্যাম্পাসটি সিরাজুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ী পরিচালনা করার জন্য ইজারা নিয়েছেন। তিনি রাজধানীতে ‘পিএইচডি বিক্রেতা’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান একজন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা। এ ছাড়া রয়েছেন নওগাঁর একজন সাংসদ, ছাত্রলীগের একজন সাবেক সভাপতি ও কয়েকজন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা।

সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (মেহেদীবাগ রোড, চট্টগ্রাম) চট্টগ্রাম শহরে তিনটি অবৈধ ক্যাম্পাস রয়েছে। চট্টগ্রামের একজন সাংসদ ও সাবেক মন্ত্রীর আপন ভাই এসব অবৈধ ক্যাম্পাস পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে তথ্য রয়েছে। নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের রাজশাহী ও খুলনায় অবৈধ ক্যাম্পাস রয়েছে। তবে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্প্রতি ইউজিসিতে দেওয়া লিখিত এক মুচলেকায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছে_ তারা ওই আউটার ক্যাম্পাস দুটি বন্ধ করে দেবে। সেখানে নতুন করে আর কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি করবে না। কেবল ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের কোর্স শেষ করবে।

দি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ রাজধানীর পুরানা পল্টন (মালিবাগ) ও প্রগতি সরণিতে (বাড্ডা) অবৈধ ক্যাম্পাস চালাচ্ছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আউটার ক্যাম্পাসের ব্যাপারে আদালতের কোনো স্থগিতাদেশ নেই। তার পরও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নরসিংদী থেকে নির্বাচিত সাংসদ যুবনেতা সিরাজুল ইসলাম মোল্লা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান। ট্রাস্টি বোর্ডে রয়েছেন মাগুরার আরেক সাবেক সাংসদ ও বিএনপি নেতা কাজী সালিমুল হক কামাল। জানা গেছে, মালিবাগে ইকরাম জুলফিক নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তি করে তার কাছে ওই ক্যাম্পাস ‘ভাড়া’ দিয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি আদালতের রায় নিয়ে চট্টগ্রামে দুটি অবৈধ ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার আশরাফ উদ্দিন। চট্টগ্রামের দু’জন সাংসদ তার ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে।
ইবাইস ইউনিভার্সিটি আদালতের রায় নিয়ে উত্তরা ও মোহাম্মদপুরে অবৈধ ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে। শীর্ষ একজন শিল্পপতি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধার। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ড. জাকারিয়া লিংকনের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব রয়েছে। এ ছাড়া মৌলবাদী ঘরানার ‘আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম’ বহদ্দারহাট এলাকায় অবৈধ ক্যাম্পাস খুলে মহিলা শাখা পরিচালনা করছে। জামায়াত নেতা শামসুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান। তিনি বর্তমানে কারাগারে। তবে তার পক্ষে সরকারদলীয় একাধিক ব্যক্তি ভূমিকা রাখায় এ প্রতিষ্ঠানের টিকিটিও স্পর্শ করতে পারছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এসব বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সমকালকে বলেন, প্রভাবশালীদের চাপে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না তা সঠিক নয়। আদালতের নানা নির্দেশনার কারণে গৃহীত অনেক সিদ্ধান্ত যথাসময়ে কার্যকর করা যায়নি। তবে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে আইন মেনে চলতে অবশ্যই বাধ্য করা হবে। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠাতারা অবৈধ ক্যাম্পাস নিজেরাই বন্ধ করে দিলে সরকারকে আর কষ্ট করে উচ্ছেদ করতে হয় না। মন্ত্রী জানান, এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান ও উপাচার্যদের সঙ্গে আজ ইউজিসিতে বৈঠক করবেন তিনি।