মূল ক্যাম্পাসের বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্য রয়েছে তিনটি হল। হলগুলোর সামনের রাস্তায় বহিরাগতদের উৎপাত, অবাধে মাদক সেবন ও নোংরা আচরণের কারণে ওই তিন হলের ছাত্রীদের চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কাটাতে হয়। এ সংকট সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ প্রশাসনের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া ক্যাম্পাস থেকে অনেক দূরের এই হলগুলো থেকে যাতায়াতের জন্যও নেই সুবন্দোবস্ত।
হল তিনটি শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল ও কবি সুফিয়া কামাল হল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে নিউমার্কেটের শেষ প্রান্তে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল ও বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল। এ দুটি হলের ছাত্রীদের প্রতিদিন নীলক্ষেত ও নিউমার্কেটের রাস্তার ঝক্কিঝামেলা নিয়ে হলে পেঁৗছাতে হয়। এর ওপর সন্ধ্যা নামলেই হলের সামনে বসে মাদকসেবী ও বখাটেদের আড্ডা। এ ছাড়া হলগেটের সামনের রাস্তায় বাজার তো নিত্যদিনের বিড়ম্বনা।
কুয়েত মৈত্রী হলের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আফরীন বলেন, ‘সন্ধ্যার পর হলের সামনে বহিরাগতদের আড্ডা বসে। তখন হলের প্রবেশদ্বারে দল বেঁধে আমাদের আজেবাজে কথা শোনায় তারা। হলের অবস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস থেকে কিছুটা দূরে হওয়ায় বহিরাগতদের এসব নোংরামি চলে। বখাটেদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশসহ প্রশাসনের কেউ এগিয়ে আসে না।’
কার্জন হলের পূর্ব পাশে নির্মিত বেগম সুফিয়া কামাল হলসংলগ্ন স্থানে সারাক্ষণ বহিরাগতদের আড্ডা থাকে। সেখানেও অবাধে চলে মাদক সেবন। চলাফেরার সুবিধার্থে কার্জন হলের সঙ্গে যুক্ত করে ওই এলাকায় ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছিল, যে ওভারব্রিজটি এখন মাদকসেবীদের অভয়ারণ্য। তাই ওভারব্রিজে পারাপার না হয়ে বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হন সুফিয়া কামাল হলের আবাসিক ছাত্রীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই হলের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রী বলেন, ‘রাস্তায় চলতে গিয়ে প্রতিদিন কোনো না কোনো সমস্যায় পড়তে হয়। বড় সমস্যা হচ্ছে হলের সামনের রাস্তায় মাদকসেবীদের আড্ডা। বহিরাগতরা রাস্তার ধারে বসেই মাদক নিচ্ছে। আমাদের দেখে বাজে মন্তব্যও করছে।’
২০১৩ সালে ক্যাম্পাস থেকে ফেরার সময় এই রাস্তাতেই এক ছাত্রীর ওড়না টানাটানি করেছিল বখাটেরা, যা তখন অনেক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে গেলে
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে মারধর করা হয়েছিল। এ ছাড়া বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের ছাত্রীদের বাধা-বিপত্তি ও নিরাপত্তাহীনতার চিত্র একই রকম। ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে টিকে আছেন হলের ছাত্রীরা।
সুফিয়া কামাল হলের আবাসিক ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, চলতে ফিরতে মাদকসেবীদের কারণে খুবই সমস্যা হয়। তাই ইচ্ছে থাকলেও হলের সামনে কেউ বসার সাহস করেন না। ওই ছাত্রী মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে ছাত্রলীগের হল শাখার নেতাকর্মীদের যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগের ওই হল শাখার এক শীর্ষ নেত্রী নিজেই মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে আড্ডা দেন। যেখানে হলের নেত্রীরাই জড়িত, সেখানে বাইরের মাদকসেবীদের কী দোষ দেব?’ ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে আনা এমন অভিযোগ অস্বীকার করে সুফিয়া কামাল হল শাখার সাধারণ সম্পাদক তিলোত্তমা শিকদার বলেন, ‘শেখ হাসিনারও শত্রু আছে। বঙ্গবন্ধুরও নিন্দা করা হয়। শত্রু তো হতেই পারে। অভিযোগ করতেই পারে। তাই আমাদের নামেও শত্রুরা অভিযোগ আনতে পারে।’
সরেজমিন দেখা যায়, শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্বরের রাস্তা সর্বত্র ফুটপাতে বসে ছিন্নমূল বখাটেরা গাঁজা, ড্যান্ডিসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক গ্রহণ করছে। এ ছাড়া সুফিয়া কামাল হলের সামনে ওভারব্রিজের ওপরে তিনজনকে মাদক সংক্রান্ত ইঞ্জেকশন নিতে দেখা গেছে। এই হলের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী চয়নিকা আহমেদ সমকালকে বলেন, ‘কার্জন হলে প্রবেশের সুবিধার্থে ফুট ওভারব্রিজ বানানো হয়েছিল। কিন্তু ওভারব্রিজের ওপর দিয়ে গেলে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। মাদকসেবীরা তাদের শরীরের এমন কিছু স্থানে ইঞ্জেকশন নেয়, যা একজন মেয়ের পক্ষে দেখা খুবই বিব্রতকর। এ ছাড়া মাদকসেবীরা ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত থাকায় সব সময় আতঙ্কে থাকতে হয়।’
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক সমকালকে বলেন, ‘সন্ধ্যার পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বন্ধ করে দেওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতে মাদকসেবীদের আনাগোনা একটু বেড়েছে। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশ টহল অব্যাহত আছে।’ তার সঙ্গে যেদিন কথা হয়, তিনি সেদিনের কথা উল্লেখ করে বলেন, সকালে বেশ কয়েকজন মাদক বিক্রেতাকে আটক করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, মাদকসেবীদের নিয়ন্ত্রণ করা এক দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। ছিন্নমূল মাদকসেবীদের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘ওদের গা-হাত-পায়ের যে অবস্থা, তাতে অন্য বন্দিদের সঙ্গে একই হাজতখানায় রাখাও সমস্যা। আমাদের সামনে যাদের দেখি, তাদেরকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিই।’
সরেজমিন দেখা গেছে, ৩ নং বিজিবি গেটের পাশে অবস্থিত শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের ছাত্রীদের প্রতিদিন হল কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত মিনিবাস অথবা রিকশা দিয়ে ক্যাম্পাসে যাতায়াত করতে হয়। কেউবা হেঁটেই হল থেকে ক্যাম্পাসে আসেন। ফলে নীলক্ষেত ও নিউমার্কেটের দুটি রোড ক্রসিং পার হতে একদিকে রয়েছে জীবনের ঝুঁকি অন্যদিকে ক্লাসে অতিরিক্ত সময় লেগে যায়। এ দুটি হলের তিন হাজার ২১১ আবাসিক ছাত্রীর জন্য রয়েছে মাত্র দুটি মিনিবাস, যা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। বাধ্য হয়েই হেঁটে বা রিকশায় যেতে হয়। কেউ কেউ গাদাগাদি করে, বাদুড়ঝোলা হয়ে প্রতিনিয়ত বাসে যাতায়াত করছেন। হলে ফেরার সময় কলা ভবন, টিএসসি এলাকা থেকে রিকশা পেতেও বেগ পেতে হয়। দ্বিগুণ ভাড়ায়ও রিকশা পাওয়া যায় না।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের খণ্ডকালীন আবাসিক শিক্ষক শাহানা নাসরীন বলেন, ‘ছাত্রীদের আবাসন সংকট ও যাতায়াত সমস্যা দূরীকরণে আমরা নিয়মিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন অফিসের সহকারী পরিবহন ম্যানেজার আতাউর রহমান জানান, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের জন্য দুটি মিনিবাস বরাদ্দ রয়েছে। হল থেকে ক্যাম্পাসে সাতবার এবং ক্যাম্পাস থেকে হলেও সাতবার যাতায়াত করে। সুফিয়া কামাল হলের জন্য একটি মিনিবাস দু’বার ক্যাম্পাসে এবং একবার হলে যাতায়াত করে। তবে তিনি স্বীকার করেন, ছাত্রীর তুলনায় মিনিবাস ও ট্রিপের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। অনেক ছাত্রী মিনিবাসে উঠতে না পেরে হেঁটেই চলাচল করেন। কেউবা যাতায়াত করেন রিকশায়। এ অবস্থায় ছাত্রীদের যাতায়াত সমস্যা লাঘবে আরও মিনিবাস প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ইভটিজিং একটা সামাজিক ব্যাধি। এর প্রতিকারে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে, সচেতন হতে হবে। তবে কেউ যদি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, আমরা তখনই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি। তিনি আরও বলেন, ছাত্রীদের যাতায়াতে দুটি মিনিবাস আছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস তো আছেই। তারপরও যাতায়াতের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হলে আমরা ব্যবস্থা নেব।