ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাল সনদে সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ!

রাধেশ্যাম সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮ সালে অনার্স ও ১৯৮৯ সালে মাস্টার্স পরীক্ষার সনদ নিয়েছেন। আর এ সনদ দিয়ে বর্তমানে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ তিনি। উপজেলা পর্যায়ে কলেজ সরকারিকরণে সরকারের নীতি ইতিমধ্যে এ কলেজের ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হয়েছে। মোহনগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ এখন মোহনগঞ্জ সরকারি ডিগ্রি কলেজ। অথচ এর অধ্যক্ষ রাধেশ্যাম সরকার ভুয়া সনদে ওই কলেজে চাকরি করছেন।

দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে কেউ জানলোই না তার সার্টিফিকেট জাল। সম্প্রতি সনদ পরীক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে পাঠানো হলে সেখান থেকে রাধেশ্যাম সরকারের ১৯৮৮ সালের ব্যাচেলর অব সায়েন্স (অনার্স) এবং ১৯৮৯ সালের মাস্টার অব সায়েন্স পরীক্ষার সনদ দুটি সঠিক নয়। এ দুটি সার্টিফিকেট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অফিস থেকে ইস্যু করা হয়নি বলে জনোনো হয়।

এ ব্যাপারে শিক্ষা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, রাধেশ্যাম সরকারের অনার্স ও মাস্টার্সের দুটি সার্টিফিকেটই জাল প্রমাণিত হওয়ায় তিনি হয়তো এইচএসসি পাস করেছেন। তাহলে ধরে নেয়া যায় এইচএসসি পাস করেই রাধেশ্যাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

Radesham

শুধু রাধেশ্যাম নন, এমন সহস্রাধিক ভুয়া সনদধারীর তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে অনুসন্ধানে। কিন্তু একের পর এক জাল সনদধারী প্রমাণিত হলেও আজ পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশনে যায়নি মন্ত্রণালয়।

এসব বিষয় নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও মন্ত্রণালয়কে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছে।

কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। ভুয়া সনদধারীদের ব্যাপারে মামলা করা ও তাদের এমপিওর টাকা ফেরত নেয়ার সুপারিশও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। প্রশ্ন উঠেছে, জাল সনদ দিয়ে তারা কিভাবে এমপিওভুক্ত হলেন। সে সময় কী যাচাই না করেই তাদের এমপিওভুক্ত করা হয়? এমনটি হলে তা ভয়াবহ চিত্র। সূত্রমতে, শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ভুয়া সনদধারীরা চাকরিস্থলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ, জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমির সনদ দেখিয়েছেন।

এসব জাল সনদেই তাদের চাকরি থেকে শুরু করে এমপিওভুক্তি, পদোন্নতি সবই হয়েছে। এক্ষেত্রে ২০১৩ সাল থেকে সনদ যাচাইয়ের কাজ শুরু করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর। তারা কাজ করতে গিয়ে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ভুয়া সনদধারী শিক্ষকের সন্ধান পেয়েছেন। এরপরই চমকে ওঠেন তারা। এ পর্যন্ত তারা সহস্রাধিক শিক্ষকের সনদ ভুয়া হিসেবে ধরেছেন। এসব সনদ পরীক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়।

সম্প্রতি যাচাই বাছাই শেষে ওইসব প্রতিষ্ঠান থেকে উত্তর আসা শুরু হয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুয়া সনদ যারা নিয়েছেন তারা হলেন- শরীয়তপুর সখিপুর ইসলামিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. সালাহউদ্দিন, যার ইনডেক্স নং-১৬৬২৮৬। তিনি বিএ পাসের জাল সনদ নিয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ নিয়েছেন নাটোরের লালপুরের মাজার শরীফ টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস কলেজের সহকারী গ্রন্থাগারিক মো. আবুল কালাম আজাদ।

তার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা ইন লাইব্রেরি সায়েন্স সনদ ভুয়া হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ নিয়েছেন মানিকগঞ্জের শিবালয় অক্সফোর্ড একাডেমির সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ রাজা মিয়া। টেকনাফ হৃীলা উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ মোস্তফাও নিয়েছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রন্থাগারিকের জাল সনদ দিয়ে কুমিল্লা ব্রাহ্মণপাড়া বড়ধুসিয়া আদর্শ কলেজে চাকরি করছেন মো. আবুল কালাম। দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় ধানমন্ডি শাখা থেকে গ্রন্থাগারিকের সনদ নিয়ে মো. হাসান তারেক চাকরি করছেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর করতোয়া কলেজে। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ নিয়ে সহকারী গ্রন্থাগারিক হিসেবে চাকরি করছেন রেজওয়ানুল ইসলাম।

তিনি দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ মনোহরপুর হাইস্কুলে চাকরি করছেন। এছাড়া সহকারী লাইব্রেরিয়ান হিসেবে শাহজাদপুর সাতবাড়ীয়া ডিগ্রি কলেজে চাকরি করছেন মোখলেছুর রহমান। তিনিও দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় ধানমন্ডি শাখা থেকে সনদ নিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ভুয়া সনদ দেখা গেছে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের।