এবারে কলেজে ভর্তি পদ্ধতি নিয়ে পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক মত প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন টক শোর সুবাদে আমরা সেটা জেনেছি। এই প্রথম এত বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী অনলাইনে নিজের পছন্দের কয়েকটি কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন করেছে।
প্রথম বা দ্বিতীয় পছন্দ অনেকেই পায়নি। মানসম্পন্ন কলেজগুলোতে আসন সংখ্যা যেহেতু সীমিত, সে কারণে এমনটিই হওয়ার কথা। এ নিয়ে অনেকের ক্ষোভ রয়েছে। ভর্তি হতে গিয়ে কিছু শিক্ষার্থী অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতায় পড়েছে। ছাত্রকে ভর্তির জন্য মনোনীত দেখানো হয়েছে ছাত্রীদের কলেজে। শত শত কিলোমিটার দূরের এলাকায় ভর্তির জন্য কারও নাম উঠেছে। এসব নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে গণমাধ্যমে। কিন্তু এ পদ্ধতির সমর্থকরা বলছেন, প্রথমবারের কারণে কিছু সমস্যা হয়েছে। এমন কিছু কলেজ রয়েছে যার নাম থেকে বোঝা যায় না সেটা ছেলেদের না মেয়েদের। কিন্তু সেই কলেজটিকে পছন্দের তালিকায় দিয়েছে শিক্ষার্থীরাই। আমার নিজের ধারণা, এ উদ্যোগ সঠিক। এবারে যা কিছু এলোমেলো ঘটনা ঘটেছে, আগামী দুয়েক বছরে সেটা ঠিক হয়ে যাবে। একবিংশ শতাব্দীতে ডিজিটাল ভর্তি পদ্ধতির বিকল্প নেই।
এবারের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সব শিক্ষা বোর্ড এবং প্রতিটি কলেজকে এখনই কাজে নেমে পড়তে হবে। স্কুলে ও কলেজে ভর্তির বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের ধারণা দিতে হবে। এবারেই অবশ্য একটি কাজ করা যেত_ কিছু নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ভর্তি চালু করা। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী বছর থেকে সর্বত্র পদক্ষেপ গ্রহণ। আমরা যে কোনো গবেষণার ক্ষেত্রে এটা করে থাকি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় নমুনা বাছাই পদ্ধতি জানে বৈকি। এটা ঠিক যে, আমাদের শহর ও গ্রামগুলোতে এমন অনেক কলেজ রয়েছে, যেখানে মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়া হয় না। তাদের অবকাঠামো সুবিধা দুর্বল, যোগ্য শিক্ষক নেই। অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে পাঠদান করা হয় এমন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানের চিত্র রীতিমতো উদ্বেগজনক। সঙ্গত কারণেই ছাত্রছাত্রীরা এ ধরনের কলেজকে ভর্তির জন্য বেছে নেয় না। সংবাদপত্রে দেখেছি, কিছু প্রতিষ্ঠান ছাত্র পায়নি। কেন এ সমস্যা, সেটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে। শিক্ষার্থীদের ভর্তি হতে বাধ্য করা চলে না। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে আসনের চেয়ে অনেক গুণ বেশি শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য প্রথম পছন্দ দিয়েছে। এটা ঠিক যে, আমরা সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এখনই অভিন্ন মানে আনতে পারব না। কিন্তু এজন্য চেষ্টা জোরদার করতেই হবে। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সরকারের পাশাপাশি চাই সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা ও আন্তরিক উদ্যোগ। বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে হবে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত কলেজগুলোতে।
কেউ ভর্তি চায় না কিংবা গুটিকয়েক শিক্ষার্থী পছন্দের তালিকায় রেখেছে এমন প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ ঢাকার বাইরে। আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন রাজধানীকেন্দ্রিক_ এটা নিয়ে আলোচনা হয় নানা পর্যায়ে। অর্থনীতিবিদরা এ সমস্যা তুলে ধরছেন। গবেষকরা জানাচ্ছেন বাস্তব চিত্র। সমস্যার প্রভাব যে অনেক ক্ষেত্রে প্রকট, সেটা জানা গেল কলেজে ভর্তির জন্য আধুনিক একটি পদ্ধতি চালু করতে গিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজ প্রবন্ধে বিলাসের ফাঁস অংশে লিখেছেন, ‘সমস্ত শরীরকে প্রতারণা করিয়া মুখেই যদি রক্ত সঞ্চার হয়, তবে তাহাকে স্বাস্থ্য বলা যায় না। দেশের ধর্মস্থানকে, বন্ধুস্থানকে, জন্মস্থানকে কৃশ করিয়া কেবল ভোগস্থানকে স্টম্ফীত করিয়া তুলিলে, বাহির হইতে মনে হয় যেন দেশের শ্রীবৃদ্ধি হইতে চলিল। সেই স্থানে এই ছদ্মবেশী সর্বনাশই আমাদের পক্ষে অতিশয় ভয়াবহ। মঙ্গল করিবার শক্তিই ধন, বিলাস ধন নহে।’ আমাদের নীতিনির্ধারকরা নিশ্চয়ই এর মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারেন।
রাজধানীতে সব ভালো কলেজ_ এমন চিত্রও শিক্ষার প্রসার ও মানের লক্ষণ হতে পারে না। ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়নের কুফল সেটা প্রকাশ পেল এভাবে। আমাদের বৃত্তি ও কারিগরি শিক্ষা নিয়েও ভাবতে হবে। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষা গ্রহণ সবার জন্য আবশ্যিক বা বাধ্যতামূলক হতেই হবে। এমনকি অনেকের জন্য স্কুল পর্যায়ের শিক্ষাই যথেষ্ট। এরপর তারা যাবে বৃত্তি শিক্ষার প্রতিষ্ঠানে। তবে এ ক্ষেত্রেও আরেকটি শর্ত পূরণ হওয়া চাই_ শিক্ষা জীবন শেষে কাজের নিশ্চয়তা। অনেক আয়োজন করে ভকেশনাল বা টেকনিক্যাল শিক্ষা দেওয়া হলো, কিন্তু চাকরি মিলল না_ এমন অবস্থা কাম্য নয়।
শিক্ষায় পিরামিড পদ্ধতি পরিচিত ধারণা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যারা ভর্তি হবে তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে না, কিংবা চিকিৎসক ও প্রকৌশলী হবে না। সমাজের সর্বত্র দক্ষ জনশক্তির চাহিদা রয়েছে এবং তা পূরণে রাষ্ট্রের পরিকল্পনা যেমন থাকতে হবে, তেমনি তার বাস্তবায়নেও চাই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ। আমাদের নতুন শিক্ষা নীতিতে এসব বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু তার বাস্তবায়নে রয়ে গেছে সমস্যা। কলেজে ভর্তির জন্য লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীর ভিড় থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট। আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়েও ভাবতে হবে। পাঠ্যসূচিতেও পরিবর্তন আনা চাই। ছাত্রছাত্রীদের সেকেলে হয়ে যাওয়া অনেক বিষয় পড়ানো হয়, যা তারা পরীক্ষায় পাসের জন্য মুখস্থ করে; কিন্তু সেটা আদৌ জীবনমুখী নয়। কেন রাষ্ট্র এমন শিক্ষার জন্য ভর্তুর্কি দেবে? কিছুদিন আগে বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়েছিল। তিনি একটি ওয়ার্কশপে তরুণদের কথা শুনতে চেয়েছেন। সেখানে তিনি বলেন, উন্নয়নের অপরিহার্য কিছু শর্ত রয়েছে এবং তার একটি হচ্ছে বিপুল সংখ্যায় শহুরে মধ্যবিত্ত থাকা। এ সংখ্যা যত বেশি হবে, সমাজের জন্য তত মঙ্গল। তাদের কেউ চোখ রাঙানি দিয়ে সহজে নত করতে পারবে না। তারা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করবে, সুশাসন চাইবে। এ সংখ্যা বাড়ানোর জন্য অবশ্য করণীয় হচ্ছে শহর ও গ্রাম সর্বত্র মানসম্পন্ন কলেজ প্রতিষ্ঠা। এজন্য অর্থ বরাদ্দে কার্পণ্য করা চলবে না। একুশ শতকের উপযোগী প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, বিজ্ঞানী, গবেষক, পেশাজীবীসহ সব ধরনের মানবসম্পদ সৃষ্টির কারখানা হয়ে উঠবে এসব প্রতিষ্ঠান।